২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

রক্ষকেরা বিক্রি হলে আদালতই ভরসা

বালু ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষতবিক্ষত সোমেশ্বরী নদী
ছবি: প্রথম আলো

নদী রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। সাধারণত প্রভাবশালী ও রাজনীতিকেরা নদী বেশি দখল করেন। সাধারণেরাও যে নদী দখল করেন না, তা নয়। নদী তাঁরাও দখল করেন। হয়তো কম। যখন যে দল ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন সেই দলীয় লোকজন নদী দখল করেন।

অধিকাংশ সরকারদলীয় লোক সব সময় বিরোধীদলীয় দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। স্থানীয় প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে নদীস্বার্থের বিপক্ষে থাকেন। হতে পারে প্রভাবশালী কিংবা রাজনীতিকদের চাপে কিংবা ব্যক্তিগত লাভালাভের কারণে। ফলে একটি নদীতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবৈধ দখল বজায় থাকে।

যাঁরা বিরোধী দলে থেকে নদী দখল করতে পারেন না, তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন সরকার বদল হলে তাঁরাও কিছু দখল করবেন। নদী-বিল উদ্ধারের আন্দোলন তীব্র হলে অবৈধ দখলদারেরা তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখার জন্য জোটবদ্ধ হন। বিলের ক্ষেত্রেও তা–ই। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভুলে দখলদারদের একটি সাধারণ পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয় যে তারা অবৈধ দখলদার। সম্প্রতি বহুদলীয় অবৈধ দখলকারীদের একটি মানববন্ধনের ছবি দেখে একজন বলেছিলেন, ‘এক ফ্রেমে সর্বদলীয় সব দখলদার!’

সরকার নদী উদ্ধার করতে গেলে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবৈধ দখলদার মামলা রুজু করেন। আন্দোলনকারীরা সোচ্চার হলে তাঁদের বিরুদ্ধে এমনকি তাঁদের পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধেও অবৈধ দখলদারেরা মামলা করেন। নদী-বিল নিজেদের দাবি করে অনেকের মামলা করার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।

একবার বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) একটি নদী খনন করতে গিয়েছিল। তখন অবৈধ দখলদারেরা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং নদী উদ্ধারের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এ ঘটনায় একবার একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রায় অবৈধ দখলদারদের পক্ষে যেতে পারে মর্মে আইনজীবী সন্দেহ পোষণ করলেন। আগাম কীভাবে তিনি এ কথা বলছেন, তা আমাদের বোধগম্য হলো না। আমি অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটি প্রাকৃতিক প্রবাহ। সরকারিভাবে এই প্রবাহ খাস। এর মালিকানা ব্যক্তির হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নদীর শ্রেণি পরিবর্তনেরও আইনগত ভিত্তি নেই। ওই আইনজীবী অনেক উদাহরণ টেনে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কাগজে যা-ই থাকুক না কেন, রায় অবৈধ দখলদারের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

কোনো কোনো অভিজ্ঞজন বললেন, অবৈধ দখলদার, তথাকথিত সরকারি রক্ষণাবেক্ষণকারী এবং সরকারি আইনজীবী সবাই এক পক্ষ। অবৈধ দখলদারেরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে উদ্ধারকারী আর সরকারি আইনজীবীকে নিজের পক্ষে রেখে দেয়।

সাংবিধানিকভাবে, আইনগতভাবে, আদালতের রায় মতে, নদীর জমি বিক্রির সুযোগ নেই। তারপরও একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি প্রশাসনের ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেন। তারপর খাজনা দেওয়ার পালা। খাজনা দেওয়া হয়ে গেলে অবৈধ দখলদার মনে করেন, খাজনা যেহেতু সরকার গ্রহণ করেছে, সুতরাং তাঁর বৈধ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলো।

অবৈধ দখলদারেরা আদালতের শরণাপন্ন হলে সাধারণত শুরুতেই বিচারক নদী বা বিলের জমির ওপর সরকারি কাজে স্থিতাবস্থার নির্দেশনা দেন। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় দেন জবাব দেওয়ার জন্য। জবাব দেওয়ার পর শুরু হয় মামলার পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া। এই আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে নদীটি উদ্ধারের কাজ শুরু হয়, তা আর থাকে না। উদ্ধারকাজ থেমে যায়। সরকারি কর্মকর্তা যাঁদের নামে মামলা হয়, তাঁরাও বদলি হয়ে যান। তিনি আর কোনো খবর রাখেন না। সরকারের পক্ষে আইনজীবী থাকলেও অনেক সময় তাঁরাও আর এসব মামলায় তেমন সক্রিয় থাকেন না। অনেকে গোপনে অবৈধ দখলদারদের বন্ধু হয়ে ওঠেন।

আইনবিদ্যায় আমার কোনো পাণ্ডিত্য নেই। সাধারণ চিন্তায় একটি বিষয় পরিষ্কার সিএস, এসএ, আরএসের যেকোনো একটি সূত্রে কোনো জমি নদী-খাল-বিল-জলাশয় হিসেবে উল্লেখ থাকলে তা বিক্রয় অযোগ্য। যেসব নদীতে ভাঙন আছে, নদী শিকস্তি, পয়স্তি আছে, সেগুলো আলাদা।

সাংবিধানিকভাবে, আইনগতভাবে, আদালতের রায় মতে, নদীর জমি বিক্রির সুযোগ নেই। তারপরও একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি প্রশাসনের ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেন। তারপর খাজনা দেওয়ার পালা। খাজনা দেওয়া হয়ে গেলে অবৈধ দখলদার মনে করেন, খাজনা যেহেতু সরকার গ্রহণ করেছে, সুতরাং তাঁর বৈধ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলো।

সাব-রেজিস্ট্রাররা মনে করেন, জমির খাজনা দেওয়া হয়েছে, সুতরাং এ জমি ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো বাধা নেই। এমনকি ভূমি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানও অবৈধ দখলদারদের পক্ষে থেকে নদী-বিল ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে। নদী উদ্ধার করতে গেলে অবৈধ দখলদারেরা আদালতের দ্বারস্থ হন। আবার অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা উদ্ধারে অনীহা প্রকাশ করলে আন্দোলনারীরাও আদালতের দ্বারস্থ হন। সিএস, এসএ, আরএস রেকর্ডেও নদীর উল্লেখ আছে। তারপরও সেগুলো বিক্রির অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে।

উচ্চ আদালত থেকে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়েছে। এখন নদী নিজেও একটি সত্তা, একটি পক্ষ। যদি স্তরে স্তরে অবৈধ দখলদারেরা নদীটি খেয়ে ফেলার চেষ্টাও করেন আর একজন বিচারক যদি নদীর পক্ষ নেন, তাহলেও নদী বেহাত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কার্যত আমাদের দেশে উচ্চ আদালত নদীর জন্য ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছেন। আদালত এখন আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল। অনেক অবৈধ দখলদার নদীর জমি দাবি করে আদালতের দ্বারস্থ হন। সে ক্ষেত্রে যাতে একজন বিচারক নদীর বিপক্ষে রায় প্রদান না করেন, সে বিষয়ে আলাদাভাবে নির্দেশনা জারি করার প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখা প্রয়োজন।

অনেক মামলা আছে, যেগুলো অসংখ্য যুক্তিতর্ক শেষে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হয়। সেখানে আইনজীবীর যুক্তিতর্ক এবং বিচারকের বিবেকের ওপর আমাদের ভরসা করতে হয়। নদী-খাল-বিল-জলাশয়বিষয়ক মামলার ক্ষেত্রে যেখানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে, সেসব ক্ষেত্রে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে ভালো হয়।

কেবল নদী নয়, খাল-বিল-জলাশয়সহ রাষ্ট্রীয় উল্লিখিত সম্পত্তির মালিক জনগণ। এগুলো কখনোই সরকারি কর্মকর্তা অন্য কারও নামে লিখে দিতে পারেন না। বরং যাঁরা নদী ব্যক্তির নামে লিখে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এতে যাঁদের যোগসাজশে নদী বেহাত হয়, তাঁরাও অনেকাংশে শাস্তির ভয়ে অপরাধ করবেন না। এসব ক্ষেত্রে আদালতই আমাদের আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারেন।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

    ই–মেইল: [email protected]