বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব সম্ভবত এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল তাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি শহরের নাগরিক থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজের দলের নেতা থেকে কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করল। ৭ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপি তার অঙ্গসংগঠন থেকে শুরু করে মূল দলের নেতা–কর্মীদের আটটি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
দেশ গড়ার কর্মসূচি একদিকে যেমন ছিল প্রশিক্ষণ কর্মশালা, তেমনি অপর দিকে এ কর্মশালার মাধ্যমে জনপরিসরে বিএনপি দল হিসেবে মোটাদাগে জনগণের জন্য কী করবে তার একটি রূপরেখা দিয়েছে। ৯টি লিফলেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী, কৃষক, কর্মসংস্থান, ক্রীড়া, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অন্যান্য ধর্মের প্রধান, জলবায়ু ও কৃষি, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, তার জানান দিয়েছে।
মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যত নির্বাচন হয়েছে, এর সব কটিতেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচিত হলে কী করবে, তা ইশতেহারের মাধ্যমে প্রকাশ করে। বিএনপিও হয়তো ইশতেহার প্রকাশ করবে সময়মতো। কিন্তু ইশতেহার একটি বড় ধরনের পুস্তিকা, যাতে সাধারণত কর্মসূচিগুলোর ডিটেইল থাকে। এত বড় পুস্তিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তোলে ধরা কঠিন। বোধ করি সে জন্যই বিএনপি এ ধরনের একটি অভিনব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যা বেশ কার্যকর হবে বলে আশা করি।
নারী: দেশের নারীদের নিয়ে বিএনপির মূল পরিকল্পনা কী, তাঁদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দলটি কী ধরনের কাজ করতে চায়, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখা তারা দিয়েছে, সেটি হলো ‘ফ্যামিলি কার্ড’। এই ফ্যামিলি কার্ড পরিবারের নারীপ্রধানকে ইস্যু করার মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়িত এবং স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। প্রান্তিক নারীদের জন্য এটি বড় ধরনের অবদান রাখবে বলে মনে হয়। কারণ, ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা অথবা খাদ্যসুবিধা প্রদান করা হবে।
স্বাস্থ্য: মানুষ যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পায়, দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পায়, তার একটা গাইডলাইন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক লিফলেটে। নতুন এক লাখ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেবার মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন যে উদ্যোগ বিএনপি নিতে চায়, তা হলো মরণঘাতী ও সংকটপূর্ণ রোগগুলোর চিকিৎসা যেন সাধারণ মানুষ দ্রুত পেতে পারে, তার জন্য পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ করা। দেখা যায়, ক্যানসারের রোগীদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির সিরিয়াল পেতে অনেক দেরি হয়। আবার অনেক সরকারি হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকে। ভুক্তভোগী সেসব রোগীকে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সরকার থেকেই প্রাইভেট হাসপাতালে পার্টনারশিপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা বিএনপি সরকার গঠন করতে পারলে গ্রহণ করবে। অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা করা হবে। বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওষুধ, স্বল্পমূল্যে ক্যানসার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ প্রাণঘাতী রোগের ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানভিত্তিক মশা নিধন ও চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
কৃষি: কৃষকদের জন্য বিশেষ ধরনের প্রণোদনা প্রায় সব সরকারের সময়ই কমবেশি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের জন্য সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড ‘কৃষক কার্ড’–এর ব্যবস্থার উদ্যোগ হবে এই প্রথম। এই কৃষক কার্ডে নানা ধরনের সরকারি সুবিধার তথ্য লিপিবদ্ধ থাকবে, যাতে কোনো ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে পড়তে না হয়। ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক পাওয়া থেকে শুরু করে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রাপ্য মূল্য নিশ্চিত করা, সহজ শর্তে কৃষিঋণ নিশ্চিত করা, কৃষিবিমার সুবিধা ইত্যাদি বিষয়গুলো এই কার্ডের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। তা ছাড়া মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আবহাওয়া ও বাজারের আপডেটেড তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাও করা হবে। ফসলের চিকিৎসাসুবিধাও ডিজিটালাইজড করা হবে। মাছচাষি ও প্রাণিসম্পদ খামারিরাও এই কার্ডের আওতায় থাকবেন।
কর্মসংস্থান: বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ এখন কর্মসংস্থানের বাইরে। বিএনপি তাদের পরিকল্পনায় কর্মসংস্থানকে বড় ধরনের গুরুত্ব দিয়েছে। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পেপ্যালসহ আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে চালু করা; তরুণ প্রজন্মের জন্য দেশব্যাপী ও ক্যাম্পাসভিত্তিক উদ্ভাবনী আইডিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিজয়ীদের স্টার্টআপ ফান্ড, প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান; কর্মসংস্থান সহজ করার বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ, দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো; গ্রামের শিক্ষাহীন, গৃহিণী, প্রবীণ ও দীর্ঘমেয়াদি বেকারদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসংস্থান প্রোগ্রাম চালু করা, মেধাভিত্তিক সরকারি নিয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার আশু কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বিএনপি।
শিক্ষা: ‘আনন্দময় শিক্ষা, দক্ষ জনশক্তি ও আধুনিক বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগের কথা বলা আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ওয়ান টিচার, ওয়ান ট্যাব; বাধ্যতামূলক তৃতীয় ভাষা শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, সবার জন্য কারিগরি শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও খাদ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া, ক্যাডার ও নন–ক্যাডার শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষার্থীবান্ধব ও শিক্ষকবান্ধব করার উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে বিএনপির উদ্যোগগুলোতে।
জলবায়ু ও পরিবেশ: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিএনপি এই খাল খনন কর্মসূচি আবার ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তাদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী ২০ হাজার কিলোমিটার খাল ও নদী পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হবে। তিস্তা ব্যারাজ উন্নয়ন ও পদ্মা ব্যারাজ প্রকল্প গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। দূষণমুক্ত বাতাসের জন্য পাঁচ বছরে ২৫ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জ্বালানি ও জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ক্রীড়া: চতুর্থ শ্রেণি থেকে খেলাধুলাকে বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিএনপি নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গানে ট্যালেন্ট হান্ট শুরু করেছিল। এবারে তারা ‘নতুন কুঁড়ি স্পোর্টস’ কর্মসূচির মাধ্যমে ১২ থেকে ১৪ বছরের প্রতিভাবান ক্রীড়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করার উদ্যোগ নেবে। ৬৪ জেলায় ইনডোর সুবিধাসম্পন্ন স্পোর্টস ভিলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিকেএসপির শাখা প্রতিষ্ঠা, সব মহানগরসহ দেশের গ্রামীণ জনপদে খেলার মাঠের সুব্যবস্থা করা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও সুবিধাবঞ্চিতদের খেলার সুযোগ নিশ্চিত করা, দেশের সব উপজেলায় ক্রীড়া অফিসার ও ক্রীড়া শিক্ষক নিয়োগ করা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের ক্রীড়াশিল্পকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়ার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।
খতিব ইমাম মুয়াজ্জিন ও অন্যান্য ধর্মের প্রধান: প্রথমবারের মতো খতিব, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মাসিক সম্মানী প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। ধর্মীয় উৎসবে বিশেষ ভাতা প্রদান, দক্ষতা-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খতিব, ইমাম-মুয়াজ্জিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগের কথা বলা আছে। অন্যান্য ধর্মের (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য) উপাসনালয়ের মাসিক সম্মানী ও উৎসব ভাতা প্রদান এবং সব সুবিধা সমানভাবে নিশ্চিত করা হবে।
বিএনপি এই আটটি লিফলেটে তাদের কিছু ফ্ল্যাগশিপ কর্মসূচি জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে চায়, যা সহজেই বোধগম্য ও উপস্থাপনযোগ্য। রাজনৈতিক দল তাদের জনমুখী কর্মসূচিগুলো জনপরিসরে কতটা প্রচার করতে পেরেছে তার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করে এবং নির্বাচন জয়লাভও অনেকটা জনবান্ধব কর্মসূচির ওপরই নির্ভরশীল। ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ স্বাস্থ্যব্যবস্থা—সবই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন। এ কর্মসূচিগুলোর সঠিক প্রয়োগ ও সফলতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বহুলাংশে বদলে দেবে বলে বিশ্বাস করি।
বিএনপির এ নতুন ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা শুধু প্রচারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। জনগণের প্রতি দেওয়া বিএনপির এ প্রতিশ্রুতিগুলো ভবিষ্যতে নির্বাচিত হতে পারলে দল হিসেবে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে সম্পাদন করবে এবং জনকল্যাণমুখী কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখবে—এই প্রত্যাশা।
সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান
প্রকৌশলী, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব