এই রমজান ফিলিস্তিনিরা জীবনে ভুলবে না

গাজায় টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যার মধ্যেও যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের ইফতার করার মতো কোনো খাবার নেই।ছবি : রয়টার্স

নাবলুস, এল-বিরেহ্‌ এবং দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমের অবৈধ চেকপয়েন্টগুলো দিয়ে আমি যখনই যেখানে যেতে পেরেছি, সেখানেই রমজানের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রূপ অনুভব করেছি। এই রমজানেই আমি আমার ধর্মের প্রকৃত অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে বুঝতে পেরেছি।

এসব জায়গায় গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, রমজান শুধুমাত্র রোজা থাকা এবং ইবাদত-বন্দেগির মাস নয়, বরং তার চেয়ে বেশি কিছু। বুঝতে পেরেছি, এটি আমাদের ইমানের শক্তির স্মারক এবং আমাদের জনগণের সংহতি উদ্‌যাপনের উপলক্ষ।

দখলকরে নেওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ক্রমাগত আগ্রাসনের হুমকির মধ্যেও আশা ও শিশুদের কলহাস্যে পূর্ণ আমি আজানের ধ্বনির অপূর্ব অনুরণন মর্মে মর্মে অনুভব করছিলাম। একই সঙ্গে একজন মুসলমান হওয়ার জন্য শুকরিয়া আদায় করছিলাম।

এই রমজানে আমি আমার ফিলিস্তিনের বাড়িতে থাকছি না। কিন্তু আমি যখন প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় ইফতার করতে বসি তখন আমার মনের মধ্যে আমার জন্মভূমির চলমান ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ভেসে উঠতে থাকে। রোজা ভাঙার সময় আমার প্রিয় স্বজনেরা এখন কীভাবে কাটাচ্ছে এবং তাদের এখন কেমন লাগছে তা ভেবে আমি ভেঙে পড়ি।

গাজায় টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যার মধ্যেও যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের ইফতার করার মতো কোনো খাবার নেই। ইসরায়েল এখনো খাবারের জন্য মরিয়া হয়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছতে বাধা দিচ্ছে। লোকেরা ইফতার ও সাহরিতে ঘাস পর্যন্ত রান্না করে খাচ্ছে।

শিশু-কিশোররা সবাই অপুষ্টিতে ভুগছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে ইতিমধ্যেই বহু লোক মারা গেছে। গাজা নামের অবরুদ্ধ ছিটমহলটির এমন কেউ নেই যে কোনো না কোনো স্বজন হারায়নি। কিন্তু সেই স্বজন হারানো মানুষগুলোকে একটু খানি শ্বাস নেওয়ার, শোক করার এবং তাদের আতঙ্ক ঘুচাবার সময় এবং স্থান কোনোটাই দেওয়া হয়নি।

সেখানে অক্ষত একটি মসজিদও আর অবশিষ্ট নেই। সেখানে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়ার মতো কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।

প্রকৃতপক্ষে, গাজার মানুষ এখনো ক্রমাগত বোমাবর্ষণের শিকার হচ্ছে। এমনকি অবরুদ্ধ ছিটমহলের সর্বশেষ তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’ রাফাতে যারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তাদের ওপর এখনো স্থল হামলা চালানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তার মানে সেখানে আরও হামলা আসছে যা নিঃসন্দেহে আরও হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা ও পঙ্গু করে দেবে।

একটা কথা নিশ্চিত, সব রমজান সমানভাবে যাবে না। এখন থেকে প্রতি বছর, আমি শুধু আর আমার নিজের জন্য দোয়া করব না। আমি দোয়া করব আমার সেই শহীদ ভাইবোনদের জন্য যারা আর নিজের জন্য দোয়া করতে পারবে না। আমি তাদের বাঁচাতে কিছু করতে পারিনি—সেই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে আমি আমার জন্য দোয়া করব। আমাদের শহীদদের আত্মার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

এই রমজানেই যে গাজাবাসীর কষ্ট হচ্ছে তা নয়। রমজান বছরের পর বছর ধরে গাজার জনগণের জন্য উদ্বেগের মাস ছিল। ইসরায়েলের লাগাতার অবরোধের কারণে চলমান এই গণহত্যা শুরুর অনেক আগে থেকেই এখানে রমজান মাসে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য নিজেরা না খেয়ে দিন কাটিয়েছে। এর আগে মৃত্যু ও ধ্বংস কখনোই এত কাছাকাছি আসেনি বটে; তবে এককালের এই সুন্দর দেশে সব সময়ই রমজানের সঙ্গে আতঙ্ক নেমে এসেছে।

পশ্চিম তীরের মানুষও এবারের মতো রমজান আগে কখনো দেখেনি। নিশ্চিতভাবেই দখলকৃত ভূখণ্ডে রমজান কখনোই সরল সোজা ব্যাপার ছিল না। রমজানে সব সময়ই অবৈধ তল্লাশি চৌকিগুলোতে টহল বাড়ানো হয়। দখলদার সেনাদের হাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের হয়রানি সহ্য করতে হয়। নানা ধরনের উসকানির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু এ বছর দখলদারেরা এসব যন্ত্রণা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা গাজায় তাদের ভাই-বোনদের গণহত্যার শিকার হতে দেখে কেবল যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে না; বরং দখলদার ইহুদি, ইসরায়েলি পুলিশ এবং সেনাদের লাগাতার আক্রমণ থেকে তাঁরা বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তারা ভাবছে, তাদের মধ্যে এর পর কে গ্রেপ্তার হবে, কাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে, বা কাকে লাঞ্ছিত করা হবে। তারা ভাবছে, তারা ও তাদের স্বজনেরা আগামী রমজান পর্যন্ত জালিমের অত্যাচার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে কি না।

আর আমরা যাঁরা প্রবাসে আছি তারা কী নিদারুণ অপরাধ বোধ নিয়ে রোজা-নামাজ করছি ইংরেজিতে কিংবা আরবিতে তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই।

যখন আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার ভাই বোনেরা মাসের পর মাস না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে, তখন কেমন করে রোজা ভাঙব? কী করে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে? আমার ভাইবোনেরা যখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নামাজ পড়ছে, তখন আমি কী করে ছিমছাম মসজিদে নামাজ পড়ব? আমি জানি ধর্মীয়ভাবে আমাকে এসব করতেই হবে। কিন্তু আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয়।

রমজানের পর রমজান যায়। ফিলিস্তিনিদের পরীক্ষা শেষ হয় না। তবে এটি নিশ্চিত, ফিলিস্তিনি চেতনা দখলদারদের নৃশংসতার চেয়ে বেশি দিন টিকে থাকবে।

যখন আমি গাজাবাসীদের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে জুমার নামাজ আদায় করতে দেখি, তখন আমি মানসিক অটলতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারি। এর মধ্য দিয়ে আমি বুঝতে পারি, আপনি কারও বাড়ি বা মসজিদ ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু কখনো তার ইমান ধ্বংস করতে পারবেন না।  

একটা কথা নিশ্চিত, সব রমজান সমানভাবে যাবে না। এখন থেকে প্রতি বছর, আমি শুধু আর আমার নিজের জন্য দোয়া করব না। আমি দোয়া করব আমার সেই শহীদ ভাইবোনদের জন্য যারা আর নিজের জন্য দোয়া করতে পারবে না। আমি তাদের বাঁচাতে কিছু করতে পারিনি—সেই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে আমি আমার জন্য দোয়া করব। আমাদের শহীদদের আত্মার প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

আহমদ ইবসাইস একজন প্রথম প্রজন্মের ফিলিস্তিনি আমেরিকান এবং আইনের একজন ছাত্র

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত