শশী থারুরের কলাম
ভারতে আদালতের কাঠগড়ায় মুসলমানদের স্থাপনা
ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা ও সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা বললেও বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে অনেক মুসলমানের কাছে ভারতের বহুত্ববাদী নীতির পরিপন্থী এবং তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছে। এ ঘটনা তাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে। ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে কীভাবে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, তা নিয়ে লিখেছেন শশী থারুর
মথুরার শাহি ঈদগাহ মসজিদের নিচে হিন্দুধর্মীয় স্থাপনার অস্তিত্ব আছে কি না, তা অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে ভারতের বিভিন্ন নিম্ন আদালতে বিভিন্ন হিন্দু গোষ্ঠী যে ১৫টি মামলা করেছে, সেসব মামলাকে একত্র করতে গত জানুয়ারির শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, এসব মামলাকে একত্র করা সব পক্ষের জন্য ভালো হবে। কারণ, যদি আলাদা শুনানি হতো, তাহলে হয়তো একেক আদালত একেক রকম রায় দিতেন, যা থেকে অস্থিরতা তৈরি হতে পারত। সব মামলা একত্র করা হলে একাধিক মামলা চালানোর ঝামেলা কমবে এবং পরস্পরবিরোধী রায়ের আশঙ্কা থাকবে না।
তবে আরও গভীরভাবে দেখলে সুপ্রিম কোর্ট সম্ভবত দেশে বাড়তে থাকা ধর্মীয় বিরোধের মধ্যে বিচারব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে এবং উত্তেজনা যেন না বাড়ে, তা নিশ্চিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভারতে একাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—এমন অসংখ্য মসজিদ আছে। এসব মসজিদ মুসলিম শাসকদের আমলে বানানো হয়েছিল। অনেক ভারতীয় মনে করেন, ওই মুসলমান শাসকেরা, বিশেষ করে মোগল শাসকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দুমন্দির ও উপাসনালয় ভেঙে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
ভারতের রাজনীতিতে এ ইস্যু খুবই সংবেদনশীল। হিন্দুত্ববাদী (হিন্দু জাতীয়তাবাদী) মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর একটি গোষ্ঠী (যা ‘সংঘ পরিবার’ নামে পরিচিত) এ বিষয়ে মানুষের আবেগ উসকে দিয়েছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম চার দশক ধরে বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে অযোধ্যায় রামের জন্মস্থান ‘রামজন্মভূমি’ পুনরুদ্ধারের দাবিতে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এ নিয়ে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতার ষোড়শ শতকের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে।
২০১৯ সালে দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলার পর আদালত হিন্দুদের পক্ষে রায় দেন এবং বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেন। সেখানে রামমন্দির নির্মাণের পর গত বছর পূজা-অর্চনার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য শহরের অন্য একটি জায়গায় পাঁচ একর জমি দেওয়া হয়।
অর্থাৎ যেখানে একটি পুরোনো মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল, সেই জমির মালিকানা শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের দেওয়া হলো। আদালত বলেছিলেন, হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানানো উচিত; যদিও এর ফলে সংখ্যালঘুদের অনুভূতি উপেক্ষিত হয়। তবু যাঁদের বিরুদ্ধে রায় গেছে (অর্থাৎ স্থানীয় মুসলমানরা), তাঁরা এ বিষয়ে কোনো বড় প্রতিবাদ করেননি।
ভারতের মুসলমানদের জন্য এ ধরনের বিরোধ শুধু কোনো নির্দিষ্ট মসজিদ বা উপাসনালয় নিয়ে নয়, বরং সমাজে তাঁদের অবস্থানের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা ও সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের কথা বললেও বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে অনেক মুসলমানের কাছে ভারতের বহুত্ববাদী নীতির পরিপন্থী এবং তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছে।
তবে মুসলমানদের আশা ছিল, রামজন্মভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার পর অন্তত শান্তি ফিরে আসবে। এ বিরোধের সমাধান হলে (যা দীর্ঘদিন ধরে উত্তর ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলেছিল) নতুন করে এ ধরনের বিতর্ক আর হবে না।
তাঁরা ভেবেছিলেন, বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির তৈরি হলে হয়তো পুরোনো এ বিরোধ চিরতরে মিটে যাবে এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো নতুন করে মোগল আমলে ধ্বংস হওয়া বলে দাবি করা অন্য মন্দিরগুলো পুনরুদ্ধারের দাবি তুলবে না।
কিন্তু না; মুসলমানদের সেই আশা পূরণ হয়নি। হিন্দুত্ববাদীরা রামজন্মভূমি নিয়ে আদালতের রায়কে শুধু একটি জমির বিরোধের সমাধান হিসেবে দেখেননি, বরং তাঁরা এটিকে হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারতের জাতীয় ধারণাকে নতুনভাবে গঠনের জয় হিসেবে দেখেছেন। এ রায় হিন্দুত্ববাদীদের মসজিদ ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেওয়ার বদলে উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছে।
অযোধ্যার মতো নতুন ধর্মীয় বিতর্ক আর যাতে না ঘটে, সে জন্য ১৯৯১ সালে ভারত সরকার ‘প্লেসেস অব ওরশিপ (স্পেশাল প্রোভিশনস) অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করেছিল। ওই আইন অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বিদ্যমান থাকা কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ের চরিত্র বদলানো যাবে না এবং এ বিষয়ে কোনো মামলাও করা যাবে না। তবে বাবরি মসজিদকে এ আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল এবং এটি পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়।
এ আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর করতে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। ২০২২ সালে বারানসির আদালত জ্ঞানবাপি মসজিদের একটি ভিডিও জরিপের অনুমতি দিয়েছিলেন। এর পর থেকেই বিভিন্ন মসজিদ নিয়ে একই ধরনের নতুন মামলার ঢল নামে।
যাঁরা এসব মামলা করেছেন, তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ আইন যদি আদালতকে কোনো উপাসনালয়ের ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে মামলা শুনতে বাধা দেয়, তাহলে এটি আইনি প্রক্রিয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ যুক্তির ভিত্তিতে আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা এবং এটি ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের অধিকারের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
লেখক উইলিয়াম এফ বাকলি বলেছিলেন, রক্ষণশীলেরা ইতিহাসের গতির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, ‘থামো!’ আর আমাদের ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাসকে উল্টো নির্দেশ দেন, ‘পেছনে ফিরে যাও!’
তাঁদের লক্ষ্য অতীতকে শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং ইতিহাসকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে বর্তমানকে নতুনভাবে গড়ে তোলা।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বুঝতে পারছেন, যদি কোনো মামলায় প্রমাণিত হয়, কোনো মসজিদ ভেঙে দেওয়া মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়েছিল, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেই মন্দির পুনর্নির্মাণের দাবি উঠবে। এভাবে প্রতিটি ‘পুনরুদ্ধার করা’ মন্দির হবে হিন্দুত্ববাদী আদর্শে নতুন এক ভারতের ভিত্তিপ্রস্তর।
ভারতে ধর্মীয় সম্প্রীতির আদর্শ ইতিমধ্যে অনেকটাই হারিয়ে গেছে। মুসলমানদের জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে মূলধারার বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন উপলক্ষে যে বিশাল উদ্যাপন হয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকার সরাসরি যুক্ত ছিল। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়ার পথে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
এসব ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়া আমাদের চোখের সামনে এগিয়ে চলেছে।
ভারতের ইতিহাস নিয়ে নানা সময় নানা বিতর্কিত বিষয় ছিল। কিন্তু আজকের দিনে ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক নতুন করে সামনে আসাটা উদ্বেগজনক। মথুরার মামলাগুলোকে একত্র করার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট এ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতগুলোকে নতুন ধর্মীয় স্থান পুনরুদ্ধারের মামলা গ্রহণ করতে এবং পুরোনো মামলাগুলোর বিষয়ে রায় দিতে নিষেধ করেছেন।
বিশেষ করে, যে মসজিদ ও দরগাহগুলো মন্দির ধ্বংসের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে মামলা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে সুপ্রিম কোর্টকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। পুরোনো মসজিদগুলোকে নতুন মন্দির দিয়ে প্রতিস্থাপন করা কোনো পুরোনো ভুলের সংশোধন নয়, বরং এটি নতুন ভুলের সৃষ্টি করছে।
এতে পুরোনো ক্ষতগুলো আবার গভীর হয়ে উঠছে। যদি বিচারব্যবস্থা এসব বিরোধের কঠোর সমাধান না করে, তাহলে মুসলমানরা প্রতিরোধ শুরু করতে পারেন। এর ফলে নতুন ধর্মীয় সহিংসতার ঢেউ উঠবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও কিছু ভুলের কথা শেখানো হবে।
আদতে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন ইতিহাসকে শুধু নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু অতীত মুছে ফেলার জন্য তাদের এ ঝোঁক ভারতের ভবিষ্যৎকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টি থেকে চতুর্থবারের মতো লোকসভায় নির্বাচিত এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ