১৪ দলে ইসলামপন্থীদের আগ্রহ ও বামপন্থীদের হতাশা

১৪ দলে ইসলামপন্থীদের নেওয়া না–নেওয়ার প্রশ্নে টানাপোড়েন চলছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। জোটটির বামপন্থী শরিকেরা আপত্তি তুলেছেন বলেও এসব খবরে লেখা হয়েছে।

মূলত, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যাতে ইসলামপন্থীদের পাল্লা ভারী না হয়, সেটাই হচ্ছে ১৪ দলের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। রাজনীতিতে এ ধরনের হিসাব-নিকাশ নতুন কিছু নয়। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সখ্য কিংবা সমঝোতা গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগও নতুন নয়। তবে এখন নতুন করে প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, কেননা নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে।

অতীতও একই সাক্ষ্য দেয়। নির্বাচনের সময় হলেই ইসলামপন্থী দল ও গোষ্ঠীগুলোর কদর বাড়ে। অন্য সময়ে বামপন্থীদের সঙ্গে বন্ধনটা টিকিয়ে রাখতে যতটুকু প্রয়োজন মনে হয়, ততটুকু ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখাই মোটামুটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে ২০০৬ সালে নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ পাঁচ দফার একটি চুক্তি করেছিল। পরে অবশ্য জোটের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধিতা ও বিতর্কের মুখে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি বাতিল করে। তবে দুই বছর পরে যখন সেই নির্বাচন হয়, তখন নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর দল বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনকে আওয়ামী লীগ একটি আসন ছেড়েছিল।

গত নির্বাচনে এই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে এ সমঝোতা অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়। প্রথম আলোর হিসাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলাম ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামি দল বেশি, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮)।

এমনকি, একসময় বিএনপির ঘনিষ্ঠ কয়েকটি ইসলামি দলও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মৈত্রী গড়েছিল। ওই হিসাবে দেখা গেছে, রাজনীতিতে সক্রিয় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৭০টি ইসলামি দল ও সংগঠনের মধ্যে ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। ৩২টি দল ছিল জাতীয় পার্টির সঙ্গে, যারা সরকারের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সমঝোতা করে নির্বাচন করেছিল। আর বিএনপির সঙ্গে ছিল মাত্র ৫টি দল।

ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের প্রাধান্য আছে—এমন একটি ইসলামি সংগঠনের শোকরানা সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়ার বিষয়টি। ভোটের হিসাবে আপাতদৃষ্টে ইসলামি ভোটের বড় অংশই আওয়ামী লীগের কবজায় থাকার কথা। সংসদে দলীয় সংসদ সদস্য রহমতুল্লাহর দাবি, দেশের দুই কোটি আহলে হাদিস ভোটার তাঁর কথায় ভোট দেন এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। দলটির জোটসঙ্গী তরীকত ফেডারেশনের প্রধান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীও সুফিবাদে বিশ্বাসীদের ওপর বেশ প্রভাব রাখেন বলে অনেকের ধারণা।

কিন্তু যাঁরা সজ্ঞানে ভুল করেন এবং বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেন সাময়িক কোনো মোহে, তাঁরা তো ওই গোত্রভুক্ত নন। রাতের ভোটের কারণে মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েও তার জন্য যারা দায়ী, তাদের সঙ্গ ত্যাগ না করতে পারলে এমনই তো হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগের অনেকেই দলের মধ্যে বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পরে আবার সসম্মানে দলে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে তো তা সম্ভব নয়, সেখানে শুধু আছে আরও গুরুত্বহীন হওয়ার একমুখী পথ।

নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর ওপর আওয়ামী লীগের এই নির্ভরতা বাড়ার বিষয়ে জোট শরিকেরা মাঝেমধ্যে উষ্মা প্রকাশ করলেও তা কখনোই আপসহীন বিরোধে রূপ নেয়নি। ফলে গত নির্বাচনগুলোর মতো এবারও তারা আওয়ামী লীগকে জোটের বাইরে আলাদা করে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছে বলে পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে। সহজভাবে বললে, কথিত বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো চরম সুবিধাবাদী কৌশল অনুসরণের ধারাবাহিকতা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। অবশ্য জোটের শরিক ইসলামপন্থী তরীকত ফেডারেশনও অন্য ইসলামপন্থীদের জোটে নেওয়ার বিরোধিতা করেছে বলে জানা যাচ্ছে। যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা যায়, ইসলামপন্থী রাজনীতির অন্য কেউ যেন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে ওঠে, সে জন্যই তাদের এ বিরোধিতা।

ক্ষমতাসীন জোট অবশ্য অনেক দিন ধরেই আওয়ামী লীগের বর্ধিত রূপ বা সংস্করণে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবন ও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টায় লক্ষণীয় গতি সঞ্চারিত হওয়ায় সম্প্রতি আওয়ামী লীগ আবারও তাদের জোটকে কিছুটা চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপির এমপিদের পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া আসনগুলোর মধ্যে তাই দুটি আসন এবং একটি সংরক্ষিত নারী আসন জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দিতে আওয়ামী লীগ কার্পণ্য করেনি। তাতে অবশ্য শরিকেরা সবাই সন্তুষ্ট হয়েছে, তা বলা যাবে না। ওই অসন্তুষ্টির কারণ যে চলতি মেয়াদের পুরোটা সময় মন্ত্রিত্ব থেকে বঞ্চিত থাকা, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আরও পড়ুন

বামপন্থীদের মধ্যেও সবার অবস্থা এক নয়। সাম্প্রতিক আসন ভাগাভাগিতে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় লাভবান হয়েছে। অন্যদিকে, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি উপনির্বাচনে ভাগে পাওয়া আসনটিতে নিজস্ব প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়ে মোটামুটি ভালো একটা ধাক্কা খেয়েছে। ৭ মার্চ ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত তাঁর এবং সাম্যবাদী দলের প্রধান দিলীপ বড়ুয়ার সাক্ষাৎকারে হতাশার ছাপ পরিষ্কার।

রাশেদ খান মেননের এখনকার উপলব্ধি হচ্ছে, জোটভিত্তিক রাজনীতি ১৪ দলে কখনোই ছিল না এবং বর্তমানেও তা অনুপস্থিত। কেন্দ্রে নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলেও তৃণমূলে তা বাস্তবায়িত হয় না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে জোট হলেও সব পর্যায়ে তার প্রতিফলন ঘটে না জানিয়ে তিনি বলেছেন, সেখানে কিছুই করার নেই। এই অসহায়ত্বের আরও প্রকট প্রকাশ ঘটেছে তাঁর পরবর্তী মন্তব্যে, যাতে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ যদি জোটগতভাবে নির্বাচন চায়, তাহলেই আসন ভাগাভাগির আলোচনা হবে। নৌকা প্রতীক না নিয়ে দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে নির্বাচন করার কথা বিভিন্ন জায়গায় বলার ব্যাখ্যাও সম্ভবত এটি।

অবশ্য রাশেদ খান মেননের চেয়েও বেশি হতাশার ছাপ মেলে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়ার মন্তব্যে। তাঁর কথায়, জোটের সোনালি দিন গত হয়েছে। ১৪ দলের মূল অঙ্গীকার ছিল যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, তার আর কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং কে কত বেশি ধর্মপন্থী, তা দেখানোর জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে।

তাঁর কথায়, ‘এটা সত্য যে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি করছে, আর আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হেফাজতের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে, যাতে বিএনপির ধর্মভিত্তিক ভোট ভাগ করা যায়। তারা মূলত একই বৃন্তের দুটি ফুল।’ তিনিও বলেছেন যে আগামী নির্বাচন এককভাবে, নাকি জোটবদ্ধভাবে হবে, তার ইঙ্গিতের জন্য তাঁরা আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে সব হতাশা ও ক্ষোভের পরও বড় দলের সিদ্ধান্তই যে তাঁরা মেনে চলবেন, সে কথাও মোটামুটি জানিয়ে দিয়েছেন।

সংবাদপত্রে এসব খবর ও বক্তব্য পড়ে তাঁদের জন্য হয়তো অনেকেই করুণা বোধ করেছেন বা সমবেদনা জানিয়েছেন। যাঁরা সরল বিশ্বাসে কোনো ভুল করে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁরা নিশ্চয়ই সমবেদনা পেতে পারেন।

কিন্তু যাঁরা সজ্ঞানে ভুল করেন এবং বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেন সাময়িক কোনো মোহে, তাঁরা তো ওই গোত্রভুক্ত নন। রাতের ভোটের কারণে মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েও তার জন্য যারা দায়ী, তাদের সঙ্গ ত্যাগ না করতে পারলে এমনই তো হওয়ার কথা।

আওয়ামী লীগের অনেকেই দলের মধ্যে বিদ্রোহ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পরে আবার সসম্মানে দলে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে তো তা সম্ভব নয়, সেখানে শুধু আছে আরও গুরুত্বহীন হওয়ার একমুখী পথ।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক