আমাদের ‘টাকা তোলা’ এমপি ও  ভারতের ‘গরিব’ অর্থমন্ত্রী 

লালপুর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন সংসদ সদস্য আবুল কালামছবি: সংগৃহীত

নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবুল কালামকে ধন্যবাদ। তিনি প্রকাশ্যে হক কথাটি বলেছেন। সব সত্য বলার সাহস সবার থাকে না। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আবুল কালাম সাহেব নির্বাচন করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সেই টাকা তুলে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক।

লালপুর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আবুল কালাম বলেন, ‘আমার পাঁচটা বছরের বেতন-ভাতার টাকা ছাড়া আমার কোনো সম্পদ ছিল না। আগামী দিনেও আমার থাকবে না। তবে এবার (সংসদ নির্বাচনে) ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এইটা আমি তুলব। যেভাবেই হোক।’

আবুল কালাম এর আগে দশম জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। ওই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার সময় ব্যাংকে তাঁর ২৫ লাখ টাকা জমা ছিল, যার বাইরে একটি টাকাও খরচ হয়নি। ওই নির্বাচনে কালাম সাহেবের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। আরও ১৫৩টি আসনের সংসদ সদস্যের মতো তিনিও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

২০২৪-এর নির্বাচনের চিত্রটা অবশ্য ভিন্ন ছিল। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যবস্থা করে। নাটোরে দলের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন শহিদুল ইসলাম ওরফে বকুল। তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ে আবুল কালাম জয়ী হন। তিনি পান ৭৭ হাজার ৯৪৩ ভোট। আর শহিদুল ৭৫ হাজার ৯৪৭ ভোট। 

আবুল কালাম নিজের কৃচ্ছ্রসাধনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সংসদ সদস্য হয়ে তিনি ২৭ লাখ টাকা দিয়ে শুল্কমুক্ত গাড়ি কিনেছেন। সে জন্য তাঁর মনে একটা আক্ষেপও আছে। তিনি চাইলে এক কোটি টাকার গাড়ি কিনে চার কোটি টাকায় বিক্রি করে দিতে পারতেন। কিন্তু সেটি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘এবার আমি ওই টাকা দিয়ে কিনব। ওই যে টাকা, ওই টাকা তুলে নিব আমি।’

এর মাধ্যমে এমপি সাহেব আগের ‘ভুল’ সংশোধন করে নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি অন্যদের মতো টাকার পাহাড় করতে চান না। কেবল খরচ হওয়া টাকাটা তুলে নিতে চান।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য যখন ভোটে জেতার পর তাঁর নির্বাচনী খরচ তোলার জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তখন ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকা নেই বলে তিনি নির্বাচন করতে পারছেন না। ভারতের জনপ্রতিনিধিরা শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা পান না। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতের জনপ্রতিনিধিদের এটাই পার্থক্য।

অনেক এমপি যে টাকার পাহাড় গড়েছেন, সেটা তাঁদের হলফনামা বিশ্লেষণ করলেই পাওয়া যায়। কারও কারও সম্পদ বেড়েছে দুই হাজার থেকে চার হাজার শতাংশ পর্যন্ত।

মো. আবুল কালাম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়েও গত দুই নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পাওয়ার পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সভাপতি একদিকে থাকলে সাধারণ সম্পাদক অন্যদিকে। রাকসুর সাবেক এসজিএস আবুল কালাম দলীয় মনোনয়ন বোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করে ভোটযুদ্ধে নেমে জিতে এসেছেন, এটা কম কথা নয়।

জেতার পর তিনি এলাকার উন্নয়নে কী করবেন, সেটা জানা না গেলেও নির্বাচনী খরচ ওঠানোর পরিকল্পনাটি জনসমক্ষে ফাঁস করে দিয়েছেন। আবুল কালাম শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেই সুবিধাটা চালু করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চতুর্থ জাতীয় সংসদে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ তৎকালীন প্রায় সব বিরোধী দল সেই নির্বাচন বর্জন করলেও পরবর্তীকালে তারা শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার সুবিধা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী-গণতান্ত্রিক কিংবা বাম-মৌলবাদীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

আরও পড়ুন

২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাতীয় সংসদের সদস্যরা এখন থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বৈদ্যুতিক গাড়ি আনতে পারবেন। আগে কেবল তেল ব্যবহৃত গাড়ির জন্য এই সুবিধা ছিল। শুল্কমুক্ত গাড়ির তালিকায় আছে অনধিক ১ হাজার ৬৫০ সিসি পেট্রল বা গ্যাসোলিন জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন মোটরগাড়ি, অনধিক ১ হাজার ৮০০ সিসি ডিজেল জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন মোটরগাড়ি; অনধিক ২০০০ সিসি জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন হাইব্রিড মোটরগাড়ি; অনধিক ২০০০ সিসি জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন মাইক্রোবাস; অনধিক ২০০০ সিসি জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন হাইব্রিড মাইক্রোবাস; অনধিক ৩০০০ সিসি পেট্রল বা গ্যাসোলিন জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন জিপ; অনধিক ৩০০০ সিসি পেট্রল বা গ্যাসোলিন জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন হাইব্রিড জিপ; অনধিক ৪ হাজার ৫০০ সিসি ডিজেল জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন একটি জিপ; অনধিক ৪ হাজার ৫০০ সিসি জ্বালানি অপসারণক্ষম ইঞ্জিন শক্তিসম্পন্ন একটি হাইব্রিড জিপ।

নবম সংসদে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, ‘৩১৫ জন এমপিকে শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধা দেওয়ায় সরকারকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার কর রেয়াত দিতে হয়েছে। দুই শতাধিক এমপি টয়োটা, ল্যান্ডক্রুজার, প্রাডো অথবা স্টেশনওয়াগন কিনেছেন। ১৮ জন সংসদ সদস্য কিনেছেন ভক্সওয়াগন টুরেজ। বাকিরা অন্যান্য মডেলের গাড়ি কিনেছেন; বেশির ভাগ সদস্য ২ থেকে ৪ কোটি টাকার কর রেয়াত পেয়েছেন। বেশ কয়েকজন এমপির পাওনা কর রেয়াতের পরিমাণ ৬ কোটি টাকার বেশি।’(প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)

দু–একজন ব্যতিক্রম বাদে দশম ও একাদশ সংসদে নির্বাচিত সদস্যরাও শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা নিয়েছেন। এর পাশাপাশি আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ ও করপোরেট মন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের খবরটি মিলিয়ে নিতে পারি। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তাঁকে যে মনোনয়ন দিয়েছিল, সেটা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে নির্মলা বলেছেন, ভোটে লড়াই করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তাঁর নেই। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ মার্চ ২০২৪)

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য যখন ভোটে জেতার পর তাঁর নির্বাচনী খরচ তোলার জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তখন ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, টাকা নেই বলে তিনি নির্বাচন করতে পারছেন না। ভারতের জনপ্রতিনিধিরা শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা পান না। আমাদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতের জনপ্রতিনিধিদের এটাই পার্থক্য।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]