বড় বড় মানুষের গল্প

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আনু মুহাম্মদ

সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা। ১৯৮৮ সালে কাজ শুরু করার পর সেখানে বহু প্রচ্ছদকাহিনি রচনা করেছিলাম। ছাত্রাবস্থায় অল্প বয়সে বিচিত্রায় লিখতাম বলে বেশ অহমিকা ছিল আমার। একদিন বিচিত্রার সহকর্মী চন্দন সরকার আমাকে বললেন, ‘আনু (আনু মুহাম্মদ) কিন্তু তোমার চেয়েও কম বয়সে বিচিত্রায় লিখত।’ মজা করে বললেন, হাফপ্যান্ট পরা বয়সে!

আমি থমকে গেলাম। আনু মুহাম্মদ বিচিত্রায় লিখতেন বিশাল ও জটিল সব বিষয়ে। জ্বালানি, অস্ত্র, খাদ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাবৃত্তি—এসব বিষয়ে। এগুলো তিনি লিখেছিলেন আমার চেয়েও অল্প বয়সে!

আনু ভাইকে আরেক রূপে দেখলাম ১৯৯১ সালে। স্মরণকালের ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী দ্বীপগুলোয়, হাজার হাজার লোকের জীবনহানি ঘটে এতে। সাহস করে সরেজমিন প্রতিবেদন করার জন্য ট্রেনে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। দেখি, বস্তায় ত্রাণ নিয়ে দুর্যোগকবলিত এলাকায় যাচ্ছেন আনু ভাই। বুঝলাম, তিনি শুধু লেখেন না, নিজে গায়ে খেটে মানুষের জন্য কাজ করেন, মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।

আনু ভাইকে এরপর যত চিনেছি, তত বেশি ভালোবেসেছি। তেল, গ্যাস, জ্বালানি সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে তিনি রাস্তার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিভিন্ন আমলে নিগৃহীত হয়েছেন, কয়েক বছর আগে পুলিশ পিটিয়ে তাঁর পা ভেঙে দিয়েছে। তিনি থামেননি। শ্রমিক অধিকার, শিক্ষা অধিকার, পরিবেশ রক্ষার লড়াই, মানুষের ভোটাধিকারসহ প্রতিটি আন্দোলনে তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

 আনু মুহাম্মদের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনাড়ম্বর নির্লোভ জীবন। অর্থ, প্রতিপত্তি, পুরস্কার, ক্ষমতা—কোনো কিছুর প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ নেই তাঁর। তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে মানুষের মুক্তি, মানুষের অধিকার। নিজে যা বলেন, ঠিক সে রকম জীবনযাপন করতে পারেন না আমাদের সমাজের বহু গণ্যমান্য মানুষ। আনু ভাই সেটাও পেরেছেন।

কয়েক দিন আগে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ দুর্ঘটনার শিকার হন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ দেখে মনে প্রশান্তি পেয়েছি। তবে কিছু মানুষ কেন তিনি খিলগাঁওয়ের অনির্ধারিত স্টপেজে নামতে গেলেন, এ প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের কাছে অনির্ধারিত জায়গায় থামার পেছনে রেলের অনিয়ম আর দুর্নীতি বা এমনকি দেশে সংঘটিত অন্য বহু গুরুতর অন্যায়ের কোনোটাই নয়, সমালোচনার বিষয় হলো কেবল আনু মুহাম্মদের নেমে যাওয়ার ভুল! এর উত্তরে ক্ষোভ জানাতে গিয়ে লিখেছেন সমাজের স্বনামধন্য অনেক মানুষ। তাঁরা বলেছেন, সামান্য আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করলে রেলে করে এভাবে অক্লান্ত ঘুরতে হতো না তাঁকে, দুর্ঘটনায়ও পড়তে হতো না।

এটা কতটা সত্য, নিজের জীবন থেকে বুঝতে পারি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কনসালট্যান্সি বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানোর কাজ করি (অনুমতি নিয়ে)। কিন্তু যোগ্যতায় অনেক এগিয়ে থেকেও আনু ভাই তা করেন না। আমাদের সৌভাগ্য, আনু মুহাম্মদের পায়ের আঙুল ভালো করা সম্ভব হবে। এটা খুব জরুরি। কারণ, এই পা শুধু তাঁর নয়, এটা আমাদের বিবেক আর দেশপ্রেমের পা।

২.

আনু ভাই আমাদের চোখে অনেক বড় একজন মানুষ। এ রকম আরও একজন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এক বছর আগে। তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণসভায় যাওয়ার পথে এবং সেখানে গিয়ে শুনলাম এই বড় মানুষের আরও কিছু গল্প।

সাভারে যাওয়ার পথে কথা বলছিলাম জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহধর্মিণী শিরিন হকের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, তিন যুগ আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিচিত্রায় আসতেন সালেহার চালানো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জিপে করে। সালেহা ছিলেন কোনো প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত প্রথম নারী গাড়িচালক। শিরিন আপা বললেন, পরে যখন সালেহার চাকরি হয় জাতিসংঘে, জাফরুল্লাহ যে কী খুশি হলেন! বাসায় ফিরে বললেন, জানো, সালেহার বেতন আমার চেয়ে বেশি এখন!

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে শুনলাম সেখানে কর্মরত আঁখি নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজনের ভাষণ। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্মরণ করে আঁখি বললেন, ‘আগে মানুষকে থামিয়ে, ভিক্ষা করে, ভয় দেখিয়ে টাকা নিতাম। নিজেকে মানুষ মনে হতো না। এখন বড় ভাইয়ের ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করি। ছাত্ররা সালাম দেয়, স্যাররা আদর করে, আপনাদের সামনে কথা বলার সুযোগ পাই। নিজেকে এখন মানুষ মনে হয়। এই জীবনটা আমাদের দিয়েছেন বড় ভাই।’

বড় বড় মানুষের এ রকম বহু গল্প আমি জানি। গ্রামে শুটিং করতে গিয়ে অসুখে বীভৎস হয়ে যাওয়া শরীরের শিশুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে চিকিৎসা করানো, রাঙামাটির দোকানদারের সন্তানকে নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে তুলে বিদেশে বড় চাকরিতে প্রতিষ্ঠা করা, গ্রামে থেকে পয়োনিষ্কাশনের জন্য কাজ করা, প্রলোভন আর ভয়কে উপেক্ষা করে পরিবেশের পক্ষে কাজ করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে একনিষ্ঠ থাকা—এমন বড় বড় মানুষ আমাদেরই চারপাশে আছেন।

৩.

এসব মানুষের গল্প এখন আড়ালে পড়ে গেছে ছোট ছোট মানুষের বাহাদুরিতে। প্রতিদিন পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইনে আমরা তাদের নানা কীর্তি দেখি। তাদের কেউ বাহিনীর বড়কর্তা থেকে সম্পদের পাহাড় গড়ে, হাজার টাকার চাকরি করে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে, কেউ ব্যাংকের পর ব্যাংক লোপাট করে, কেউ নানা ফন্দিফিকিরে রাষ্ট্রের সম্পদ কুক্ষিগত করে বিশ্বসেরা বড়লোক হয়ে যায়, কেউ মানুষ খুন করার নেতৃত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় পদক বাগিয়ে নেয়, কেউ বিনা ভোটে জেতে এলাকায়, আবার কখনোবা রাষ্ট্রের জমিদার বনে যায়। তাদের সরাসরি সমালোচনা করার সাহস পায় না কেউ, কোনো আদালত তাদের বিচার করে না, কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে না।

এসব মানুষের সংবাদে ভরে থাকে গণমাধ্যম। বড় মানুষের অবয়ব ধরে তারা প্রতিদিন আমাদের ক্লিষ্ট, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে। কিন্তু তারাই সব নয়; এই সমাজে আছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর আনু মুহাম্মদের মতো সত্যিকারের বড় মানুষেরাও। আছে তাঁদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে—এমন বহু তরুণ।

হয়তো এ জন্যই এখনো টিকে আছি আমরা। হয়তো এ জন্যই বাংলাদেশ পথ খুঁজে পাবে একদিন। 


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক