পাকিস্তানের বিপথগামী উন্নয়ন

ইসলামাবাদে সরকারিভাবে গমের আটা বিক্রির লাইনে মানুষের ভিড়
ছবি: এএফপি

ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে পাকিস্তানিরা সবাই এখন লাইনে দাঁড়িয়ে। দরিদ্র মানুষ স্বল্প মূল্যের আটার জন্য লাইনে, আর উচ্চবিত্তদের উপচে পড়া ভিড় সদ্য খোলা কানাডীয় চেইন শপ ‘টিম হর্টেন্স’-এর সামনে, উচ্চ মূল্যের কফি ও পেস্ট্রি কেনার জন্য। খোলাবাজারে আটার দাম প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ রুপি আর সরকারি রেশন দোকানে ১০ কেজি আটার ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে ৬৫ রুপিতে।

সশস্ত্র প্রহরায় বিতরণ করা হচ্ছে এসব আটা। অসম্ভব ভিড়ে একজনের মৃত্যুও ঘটেছে বলেও খবর বের হয়েছে। এর বিপরীতে ‘টিম হর্টেন্স’, পাকিস্তান জানিয়েছে, কানাডীয় এ ব্র্যান্ড ৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রির রেকর্ড গড়েছে লাহোরে। ফেব্রুয়ারিতে সেখানে এই কফি শপ চালু হয়েছে। প্রায় দেউলিয়া পাকিস্তানের একশ্রেণির মানুষ ৩৫০ পাকিস্তানি রুপি দিয়ে ছোট্ট এক কাপ কফি গিলছে, বড় সাইজের এক কাপ কফির দাম এর দ্বিগুণ।

ভৌত অবকাঠামো নিয়ে মোহ

এদিকে পাকিস্তানের সরকারগুলো অধিক হারে বিমানবন্দর, রাস্তা, মেট্রো, রেলপথ গড়েই চলেছে; যদিও আগে নির্মিত অনেক ভৌত অবকাঠামো এখনো অব্যবহৃত। প্রভাবশালী সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট ২০১৭ সালে ‘গন্তব্যহীন সড়ক: ভৌত অবকাঠামো নিয়ে পাকিস্তানের বিপথগামী মোহ’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে তারা ইসলামাবাদ ও লাহোরের সংযোগকারী ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত মোটরওয়ে অব্যবহৃত থাকার কথা উল্লেখ করে। কারণ, আগে থেকেই এ দুই শহরের মধ্যে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আছে, যার দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার কম। এ সড়কে টোল নেই।

বিপথগামী উন্নয়নের এসব লক্ষণ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে কমবেশি বিদ্যমান। তাই এগুলো থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। অন্যথায় বৈশ্বিক বা দেশীয় কোনো বিপর্যয় ঘটলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে যা ঘটেছে, অন্যান্য দেশেও তা ঘটতে পারে।

ফলে, চালু হওয়ার ২০ বছর পরেও নতুন এই মোটরওয়েতে মাইলের পর মাইল গাড়ি চালিয়েও গতিসীমা লঙ্ঘনকারী চালকদের ধরার জন্য ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির দেখা পাওয়া যায় না! লেখাটি প্রকাশের পর সরকার–সমর্থকেরা নিবন্ধটিকে ‘হিন্দুত্ব’ দ্বারা অনুপ্রাণিত ও অর্থহীন এবং লেখককে গবেট বলে মন্তব্য করে। সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রকল্পটিকে তাঁর সবচেয়ে গর্বের অর্জন বলে দাবি করেন। তিনি মনে করেন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিশ্চিত পদ্ধতি।

অন্যদিকে দেশটিতে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের অর্ধাংশই স্কুলের সুবিধাবঞ্চিত। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় অপ্রতুল। কারণ, তারা ধনীদের থেকে কর আদায় করতে সংকোচ বোধ করে, দেশের মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ লোক আয়কর দেন। এ কারণেই বিশ্বব্যাংক বলছে, পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উন্নত পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর।

পাকিস্তানের ভৌত অবকাঠামো অব্যবহৃত থাকার কারণে অর্থনীতিতে যে তেজিভাব প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা আসেনি। তা সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফ দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের আওতায় পাকিস্তানের গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদর থেকে চীন পর্যন্ত সংযোগ, দেশব্যাপী নতুন রাস্তা, বেশ কয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রভৃতি প্রকল্পে আরও ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের পথ ধরেছিলেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করেছিলেন, বাণিজ্যিক শর্তের এসব ঋণ পরিশোধে পাকিস্তান হিমশিম খাবে।

পাকিস্তানের আর্থিক সংকট

অর্থনীতিবিদ ও সরকারের সমালোচকদের আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি বিল মেটানো যাবে। সম্প্রতি এক দিনে পাকিস্তানি রুপি তার সর্বোচ্চ মূল্য হারিয়েছে। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ২৭০ পাকিস্তানি রুপি।

গড় মূল্যস্ফীতির হার ২৫, যা জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক ১৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ও রুপির অবমূল্যায়নের কারণে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে আছে, লোডশেডিং হচ্ছে ব্যাপকভাবে, শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। বিদ্যুৎ খাতের চক্রাকার ঋণ ২০১৩ সালে ৪৫ হাজার কোটি রুপি থেকে বেড়ে ২০২০ সালে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি রুপিতে দাঁড়িয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, মাত্র ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন রিজার্ভের বিপরীতে জুনের মধ্যে পাকিস্তানকে ১০ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ করতে হবে। দেউলিয়াত্ব এড়ানোর জন্য মিত্রদেশ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কাছে হাত পেতেছে। আইএমএফের সঙ্গে ঝুলে যাওয়া আলোচনা আবার শুরু করেছে এবং সংস্থাটির প্রস্তাবিত তিক্ত দাওয়াই গিলতে সম্মত হয়েছে।

আরও পড়ুন

সংকটের কারণ

পাকিস্তান সরকার বলছে, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমান সংকটের কারণ। এ কথা সত্যি, ভয়াবহ বন্যায় দেশটিতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যশস্য আমদানির ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সংকটের আরও গভীর কারণ রয়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের আর্থিক সংকট বিষয়ে দ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। সেখানে অন্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত অধ্যাপক আতিফ মিয়া। তিনি বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সংকটের মূল কারণ সেনা পরিচালিত পারিবারিক শাসন। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ পরিবারের শাসন চলছে। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর আস্থা ধরে রাখতে ব্যর্থতার কারণেই ইমরান খানকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।

আতিফ মিয়া বলেন, পারিবারিক শাসনে ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের ভাই–বেরাদার, আত্মীয়স্বজন ও স্তাবকদের দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করেন, যাঁদের এ ধরনের সংকট মোকাবিলার জ্ঞান বা দক্ষতা কোনোটাই নেই। পারিবারিক শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য কায়েমি স্বার্থ তোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ব্যয় হ্রাস করা হলেও সেনাবাহিনীর বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি থেকে তাঁর এ বক্তব্যের যথার্থতার প্রমাণ মেলে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভারত নেহরু পরিবারের শাসনের মধ্যে থেকেও মনোমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করে এ অচলায়তন ভেঙে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে পেরেছে।

বিপথগামী উন্নয়নের লক্ষণ

পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার বিষয়ে আলোচনা থেকে আমরা বিপথগামী উন্নয়নের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে পারি।

১. পারিবারিক শাসনে ক্ষমতাসীনেরা তাঁদের ভাই–বেরাদার, আত্মীয়স্বজন ও স্তাবকদের দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করেন, যাঁদের এ ধরনের সংকট মোকাবিলার জ্ঞান বা দক্ষতা কোনোটাই নেই। এ ধরনের ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য কায়েমি স্বার্থ তোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

২. ভৌত অবকাঠামো, বিশেষ করে দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প উন্নয়নের সমার্থক নয়। তবে উপযুক্ত ভৌত অবকাঠামো, সঠিক ব্যয় ও সময়ে বাস্তবায়ন করলে এবং জনগণ তা ব্যবহার করলেই কেবল উন্নয়ন সহায়ক হতে পারে।

৩. ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর বরাদ্দের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। সেতু, রাস্তাঘাট, মেট্রোর পাশাপাশি পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় না বাড়ালে উন্নয়ন বিপথগামী হবে।

৪. কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত না করতে পারলে সব উন্নয়নের প্রচেষ্টাই ভেস্তে যাবে।

৫. বৈদেশিক মুদ্রায় বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণে সতর্ক না হলে ব্যষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।

 ৬. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সতর্কতার অভাব বিপদ ডেকে আনতে পারে।

পাকিস্তানের বিপথগামী উন্নয়ন থেকে শিক্ষা

বিপথগামী উন্নয়নের এসব লক্ষণ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে কমবেশি বিদ্যমান। তাই এগুলো থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। অন্যথায় বৈশ্বিক বা দেশীয় কোনো বিপর্যয় ঘটলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে যা ঘটেছে, অন্যান্য দেশেও তা ঘটতে পারে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব