ইসরায়েল কেন যুক্তরাষ্ট্রে হলো না

গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ গণহত্যা শুরুর পর নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গন করে সমর্থন জানান বাইডেন

ফিলিস্তিনি শিশুসহ সব স্তরের মানুষের ওপর ইসরায়েলি নৃশংসতার দুটো দিক: একটি হলো ইসরায়েলের আগ্রাসন ও সুপরিকল্পিত গণহত্যার ধারাবাহিকতা এবং অন্যটি হলো এর অবসানে আন্তর্জাতিক সব আইন ও প্রতিষ্ঠানের অকার্যকারিতা।

বহু বছর ধরে তো চলছেই, শুধু গত ৭ অক্টোবরের পর থেকেই ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ১৪ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, এর মধ্যে প্রায় ৬ হাজার শিশু এবং ৪ হাজার নারী। জখম হয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। নিখোঁজ প্রায় ৬ হাজার। এগুলো কি শুধুই সংখ্যা? একেকজনের সঙ্গে কত মানুষ, আর এই নৃশংসতা যে ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি করে, তা কত দূর যাবে?

জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বিশ্বের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হওয়ার কারণ বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তি যুক্তরাষ্ট্র দখলদার ইসরায়েল সরকারের পক্ষে, আর যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বড় রাষ্ট্রগুলো তার পেছনে। শুধু পক্ষে বললে ভুল হবে, এই গণহত্যা অব্যাহত রাখতে তারা জাতিসংঘসহ সব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। তাহলে বিশ্ব কীভাবে চলে?

আইন, প্রতিষ্ঠান এগুলো কই? যুক্তরাষ্ট্র বহুবারই দেখিয়েছে যে এই বিশ্ব চলে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ পদ্ধতিতে। নিজেদের অপরাধের বৈধতা দিতে তারা কীভাবে গণমাধ্যম ব্যবহার করে, তার বহু প্রমাণ আছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি দাবির ওপর ইরাক দখল হলো, ১০ লক্ষাধিক মানুষ খুন করা হলো। এর জন্য যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কয়েকজন মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়ার কথা। হয়নি, আর যুক্তরাষ্ট্র এই আদালতের সদস্যপদই নেয়নি।

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালানোর পর থেকে ইসরায়েলেরও সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এর দায় কার? হামাস নামের একটি সংগঠনের, না ইসরায়েল রাষ্ট্রের, না ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর?

এর উত্তর পাওয়া যায় ইসরায়েলেরই একজন লেখক ও সাংবাদিক গিডিওন লেভির প্রতিক্রিয়ায়। তিনি এর দুই দিন পর সে দেশেরই পত্রিকা হারেৎজ-এ লিখেছেন এভাবে, ‘এই সবকিছুর জন্য দায়ী ইসরায়েলি ঔদ্ধত্য; এ রকম একটা ধারণা যে, আমরা যা খুশি তা করতে পারি, এ জন্য আমাদের কোনো মূল্য দিতে হবে না এবং কোনো শাস্তি পেতে হবে না।...আমরা ফিলিস্তিনিদের গ্রেপ্তার করব, হত্যা করব, হয়রানি করব, উচ্ছেদ করব আর তাদের ওপর গণহত্যা কার্যক্রম চালানো শেটেলার বা দখলদারদের রক্ষা করব। আমরা নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চালাব, তাদের চোখ তুলে ফেলব, মুখ ভেঙে ফেলব, তাদের বহিষ্কার করব, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করব, তাদের বিছানা থেকে তুলে নিয়ে আসব এবং অবশ্যই গাজা উপত্যকায় অবিশ্বাস্য অবরোধ চালিয়ে যাব আর ধরে নেব সবকিছু ঠিকমতো চলবে।’ (বাংলা অনুবাদ-সর্বজনকথা, নভেম্বর ২০২৩)

আরও পড়ুন

এটা মনে রাখতে হবে যে একটি সম্প্রদায় হিসেবে ইহুদি জনগোষ্ঠী হাজার বছর ধরে নির্যাতিত হয়েছে। এই নির্যাতনে প্রধান ভূমিকা ছিল ইউরোপের খ্রিষ্টান নেতাদের। ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ ও ঘৃণা এত প্রবল ছিল যে সব অঘটন, রোগ, সংঘাত, মহামারির জন্য তাঁরা ইহুদিদের দায়ী করতেন।

অসংখ্য নিরীহ ইহুদি এই বিদ্বেষ এবং তার থেকে ছড়িয়ে পড়া নৃশংসতার বলি হয়েছেন। নারী-শিশুও বাদ যায়নি। হিটলারের শাসনামলে এই ধারা ভয়ংকর আকার নেয় এবং হলোকাস্টের নৃশংসতার সৃষ্টি হয়। হিটলারের কাছে শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান ছাড়া সবাই ছিলেন নিকৃষ্ট।

নিপীড়িত ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জোরদার হয় উনিশ শতকে। কারণ, তখন ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ বাড়ছিল। ১৮৯৬ সালে অস্ট্রিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক ও লেখক থিওডর হার্জ প্রথম বিষয়টি গুছিয়ে প্রকাশ করেন তাঁর দ্য জিউইশ স্টেট গ্রন্থে। এর পর থেকে নিয়মিত জিয়নবাদী সম্মেলন আয়োজিত হতে থাকে। তবে হার্জের কল্পিত রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক ছিল না, ছিল সেক্যুলার—গণতান্ত্রিক। ১৯০৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৯০৫ সালে সপ্তম জিয়নবাদী কংগ্রেসে ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একাধিক স্থান প্রস্তাব করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আর্জেন্টিনা, উগান্ডা ও ফিলিস্তিন। অবশেষে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, এ রাষ্ট্রের নাম হবে ইসরায়েল। কিন্তু দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে ফিলিস্তিনকে কেন বাছাই করা হলো?

ইসরায়েলি ইহুদি ইতিহাসবিদ ইয়ান প্যাপে তাঁর টেন মিথস অ্যাবাউট ইসরায়েল গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ফিলিস্তিনকে বাছাই করার যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ‘জনমানবহীন ভূমিতে ভূমিহীন মানুষ স্থানান্তর’। তিনি বলেন, ‘এটি খুবই ভুল। কারণ, ফিলিস্তিনে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বহু আগে থেকেই ছিলেন। তাঁদের সহাবস্থানে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যখন স্থানীয় লোকজনকে হটিয়ে অভিবাসী ইহুদিরা নিজেদের বাড়ি বানাতে শুরু করেন, অনেক জায়গায় ফিলিস্তিনিরা উদ্বাস্তু হতে শুরু করেন, তখনই সংঘাত শুরু হয়।’

ফিলিস্তিনকে নির্বাচন করার আরেকটি প্রধান যুক্তি ঈশ্বরের নির্দেশ। এই বিশ্বাসই জায়নবাদ। ‘তোরা’র আধুনিক ইংরেজি অনুবাদে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বর আব্রাহামকে নির্দেশ দেন, তুমি সত্বর তোমার দেশ, তোমার মানুষ ও পিতৃভূমির নিবাস ত্যাগ করো এবং যে ভূমির দিকে আমি নির্দেশ করি, সেখানে যাও।’ এ বাণীই ইহুদিদের নতুন রাষ্ট্র নির্বাচনের প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

ইহুদিদের জন্য যদি তাদের আসলেই সহানুভূতি থাকত, তাহলে তারা আরও ভালো জায়গা খুঁজে পেতে পারত, যেমন ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া। সেখানে কোথাও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে তাদের জন্য শান্তিপূর্ণ নিরাপদ বাসভূমি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইউরোপীয়রা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় জবরদখল করে নিজেদের রাষ্ট্র বানিয়েছে, সেই মডেলেই তারা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।

সাধারণ মানুষের অসহায় বিশ্বাসের বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটিশ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীরা কেন ইহুদি রাষ্ট্র বানানোর জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচনে পৃষ্ঠপোষকতা দিল, যেখানে মানববসতি আছে এবং সেখানে পুরোনোদের হটিয়ে নতুন রাষ্ট্র করতে গেলে সমস্যা-সংঘাত হবেই।

ইহুদিদের জন্য যদি তাদের আসলেই সহানুভূতি থাকত, তাহলে তারা আরও ভালো জায়গা খুঁজে পেতে পারত, যেমন ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা, অস্ট্রেলিয়া। সেখানে কোথাও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে তাদের জন্য শান্তিপূর্ণ নিরাপদ বাসভূমি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইউরোপীয়রা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় জবরদখল করে নিজেদের রাষ্ট্র বানিয়েছে, সেই মডেলেই তারা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সম্ভাব্য সংঘাতকে তারা নিজেদের পুঁজি বিবেচনা করে।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান বা ওসমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পুরো অঞ্চল পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ভাগাভাগি করে নেয়। এ ধারাতেই তাদের জন্য খুঁটি হিসেবে সৃষ্টি হয় সৌদি আরবের পাশাপাশি ইসরায়েল। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের ‘বেলফোর ঘোষণা’য় ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর ভয়ংকর নির্যাতনের পর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূমির ওপর ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হয় ইহুদিদের একটি নিরাপদ বাসভূমি করার কথা বলে। এভাবে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের ওপর চির আধিপত্য রক্ষার জন্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা নেয়। মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম রাজতন্ত্রী শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতার বড় কারিগরও তারাই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছর ধরে জোরজবরদস্তি আর ঘৃণ্য অপরাধ করার পর ইসরায়েল কী পেল? তারা কি ইহুদিদের জন্য নিরাপদ একটি রাষ্ট্র পেয়েছে? অথবা কি বিশ্ববাসীর কাছে একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে? অবশ্যই না। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম বন্ধুদের থেকেও তারা সমর্থন পায় না। একটা বর্ণবাদী দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে তারা বরং ঘৃণাই কুড়িয়েছে কেবল।

ইসরায়েলের সর্বশেষ গণহত্যা শুরুর পর নেতানিয়াহুকে বাইডেনের আলিঙ্গন করে সমর্থন ব্যক্ত করা এ সময়ের সবচেয়ে অশ্লীল দৃশ্য। আর এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণি-বয়সনির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ মিছিল, গান, কবিতা, ছবি আঁকা হচ্ছে এই সময়ের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। এই প্রতিবাদী মানুষদের মধ্যে মুসলমান, খ্রিষ্টান, হিন্দু, প্রকৃতিপূজারি, অবিশ্বাসীসহ সব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মানুষই আছেন, আছে ইহুদিরাও।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অনেক ইহুদি ধর্মগুরুও ইসরায়েলের গণহত্যার নিন্দা করেছেন। ইসরায়েলের ভেতরে বাম সেক্যুলারপন্থী রাজনীতি সংস্কৃতির মানুষেরা বহু বছর ধরেই কঠিন লড়াই করছেন। তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়, জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তারপরও তাঁরা কাজ করছেন।

প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাতকে তাই খণ্ডিত ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে দেখা খুবই ভুল। এডওয়ার্ড সাঈদ খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন, তিনি ফিলিস্তিনি এবং উদ্বাস্তু হিসেবে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে বিশ্বসভায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন।

ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া নোয়াম চমস্কি বহু বছর ধরে ইসরায়েলি দখলদার আগ্রাসী ভূমিকার সমালোচনা করে আসছেন। তিনি নিজেও ইসরায়েলি লবির আক্রমণের শিকার। এ রকম অনেকেই আছেন। আসলে সমস্যার মূল বুঝতে গেলে বর্তমান বিশ্ব ক্ষমতার কাঠামো দেখতে হবে, এই (অ)ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিশ্ব সংহতির পক্ষে দেশে দেশে কাজ করতে হবে।

  • আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক