ইউরোপে ফ্রিডম অব স্পিচ বা কথা বলার স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। বিষয়টি ওপর থেকে দেখলে তাই অনুমিত হবে। কিন্তু নিজেদের রাজনীতি বা স্বার্থের বাইরে কিছু ঘটলে, কথা বলার স্বাধীনতাই নিষেধাজ্ঞা জারি হবে।
সম্প্রতি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সেই সত্যটি প্রকাশ হয়েছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। ইউরোপের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার এই চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন, শিল্পচর্চা থেকে খেলার মাঠ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইউরোপীয় মানবাধিকার, গণতন্ত্রচর্চা ও কথা বলার অধিকার নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে সুনাম রয়েছে, তা এখন কালিমালিপ্ত।
পশ্চিমাদের কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানবেতর ঘটনা ঘটলেও ইউরোপজুড়ে গোটা কয়েক বুদ্ধিজীবী, দার্শনিকেরা মুখ খুলছেন। একই অবস্থা পৃথিবীখ্যাত ইউরোপ–আমেরিকার তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনের গাজাতে অবর্ণনীয় অবস্থার মুখে হাজার হাজার নারী, শিশু বা সাংবাদিকেরা মারা যাচ্ছে।
অথচ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা জার্নালিস্ট উইদাউট বর্ডার একবারও মুখ খুলছে না। ইসরায়েলের সমালোচনা করে ফিলিস্তিনের পক্ষে কেউ কিছু বললে বা লিখলে তাকে ইউরোপে প্রচলিত তথ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় নাজেহাল করা হচ্ছে।
আদতে হচ্ছেও তা–ই, গত ৪ নভেম্বর বার্লিনে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ আয়োজন করা হয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার লোকের সংহতি মিছিলে দেখা হয়েছিল মিসরের ছেলে ইয়াহিয়া আবদেল ওসামার সঙ্গে। হ্যানোভার শহরে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেখানে তিনি শুধু সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছিলেন। আর সেই কারণে তার কাজের জায়গায় এখন নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সম্প্রতি জার্মান দার্শনিক এবং সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জুলিয়ান নিদা-রমেলিন বলছেন, ‘নানা বিষয়ে পশ্চিমাদের আত্মপ্রচারণা আসলে আত্মপ্রতারণা।’ তিনি বার্লিনার জেইতুং পত্রিকাকে বলেছেন, প্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে পশ্চিমে একটি নির্বুধিতা আছে।
পশ্চিমারা যদি ভাবে মিসরে মোবারক, ইরাকে সাদ্দাম হোসেন বা সিরিয়ায় আসাদের মতো নেতাদের পতন ঘটানো যায়, তবে সেখানে পশ্চিমা ধাঁচের, উদার গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবির্ভূত হবে। কিন্তু কেন এটা ঘটতে হবে?
শুধু স্বৈরশাসকদের উৎখাত করার কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটবে বলে আশা করাটা ভ্রান্ত ধারণা। আজ ইরাক লিবিয়া বা আফগানিস্তানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের পর কী ঘটছে, তা আমাদের দেখতে হবে। পশ্চিমাদের ভুল হস্তক্ষেপের কারণে সেখানে মৌলবাদ আরও বেড়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি পশ্চিমাদের ইউরোপের দেশে দেশে কট্টরবাদী জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান থামানোর দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন। জার্মান মিডিয়ায় ফিলিস্তিন, শরণার্থী এবং অভিবাসন বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের তিনি নিন্দা করেন।
উত্তর জার্মানির লুনেবার্গ শহরের লিউফানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দার্শনিক এবং লেখক রিচার্ড ডেভিড প্রেচ্টকে সম্মানসূচক অধ্যাপক পদ থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ তথ্য জানিয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগ করা হলে তিনি তাঁর পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
৭ নভেম্বর ব্যাভেরিয়া প্রদেশের পুলিশ মিউনিখ শহরে ১৭ জন ব্যক্তির বাড়ি তল্লাশি করে তাঁদের কম্পিউটার জব্দ করেছে। ২ জন নারী ও ১৫ জন পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে এবং ইহুদিবিদ্বেষী কথা লিখেছে। অবশ্য এখন এ ধরনের ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জার্মানিজুড়ে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে।
জার্মান ফুটবল লিগ বা বুন্দেসলিগায় এফএসভি মাইনজ ফুটবল দলের ২৮ বছর বয়সী মরোক্কান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় আনোয়ার এল গাজী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরায়েলবিরোধী পোস্ট দেওয়ার কারণে মাইনজ ফুটবল দল, তার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছে। কর্তৃপক্ষ বলেছে ক্লাবের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও স্ট্রাইকার গাজী বারবার ইসরায়েলবিরোধী ইনস্টাগ্রাম পোস্ট প্রকাশ করছিল।
এল গাজি জানিয়েছে, সতর্ক হওয়ার পর ‘আমি নতুন পোস্টে এমন কোনো বিবৃতি দিইনি, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দ্বারা নিষিদ্ধ’। আনোয়ার এল গাজি তাঁর সঙ্গে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
উত্তর জার্মানির শ্লিসভিগ হোলস্টেইন রাজ্যের সামাজিক মন্ত্রী ছিলেন পরিবেশবাদী সবুজ দলের আমিনাটা টোরে। তিনি গত ১৭ অক্টোবর ফটো শেয়ারিং সাইট ইনস্টাগ্রামে ইসরায়েলের সমালোচনা করে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এই পোস্ট দেওয়ার পর তাঁর মন্ত্রিত্ব চলে যায়। মন্ত্রী আমিনাটা টোরে বলেন, এই পোস্টটি তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান। শ্লিসভিগ হোলস্টেইন রাজ্য সরকারের মতামত নয়। তবু তাঁকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ‘আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছি, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে কোনো সময় প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়।’
জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকাটি জানিয়েছে, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় জার্মানির তিন শহর ম্যানহেইম, লুডভিগশহাফেন ও হাইডেলবার্গে ফটোগ্রাফির জন্য পরিকল্পিত চতুর্থ বিওনালে বাতিল করা হয়েছে। কারণ, ফেসবুকে ইহুদিবিরোধী পোস্ট।
বাংলাদেশর তিন স্বনামধন্য আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম, তানজিম ওয়াহাব এবং মুনেম ওয়াসিফ ওই আলোচ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন। আয়োজক শহরগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনজন কিউরেটরের একজন শহিদুল আলম তাঁর ফেসবুকে ‘ইহুদিবিরোধী পোস্ট’ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতের একটি সাক্ষাৎকারে হলোকাস্টের সঙ্গে বর্তমান যুদ্ধের তুলনা এবং গাজায় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরায়েল রাষ্ট্র কর্তৃক গণহত্যার অভিযোগ করেছেন।
সম্প্রতি স্পেনের বার্সেলোনায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জোটের ফোরামের সভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার মানবিক আইনসহ আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা উচিত। ইইউ বিপুলসংখ্যক বেসামরিক হতাহত, বিশেষ করে হাজার হাজার শিশু ও নারীর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। এ ছাড়া একটি ভয়াবহতা আরেকটি ভয়াবহতাকে সমর্থন করতে পারে না।’
অথচ ইউরোপের অনেক দেশেই ইসরায়েলের সমালোচনা বা ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে কিছু বলা যাচ্ছে না। জার্মান সাংবাদিক এবং লেখক অ্যালিস হ্যাস্টারস লিখেছেন, ‘আমি ইসরায়েল সরকার এবং তাদের সহিংস কাজের সঙ্গে ইউরোপীয় সরকারগুলোর একপেশে সংহতির নিন্দা করি। মনে হচ্ছে যেন জার্মানি শুধু মুসলিমবিদ্বেষী এবং ফিলিস্তিনিবিরোধী বর্ণবাদ ছড়িয়ে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছে।’
আদতে হচ্ছেও তা–ই, গত ৪ নভেম্বর বার্লিনে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ আয়োজন করা হয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার লোকের সংহতি মিছিলে দেখা হয়েছিল মিসরের ছেলে ইয়াহিয়া আবদেল ওসামার সঙ্গে। হ্যানোভার শহরে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেখানে তিনি শুধু সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছিলেন। আর সেই কারণে তার কাজের জায়গায় এখন নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ইউরোপের মানবিকতা, মানবাধিকার ও কথা বলার স্বাধীনতার যে কথা আমরা অহরহ শুনে থাকি, তার গভীরে গেলে অন্য কদাকার রূপ প্রকাশ পাবে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]