কয়েক মাস ধরে ইউক্রেন তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছে ২৫ বছরের নিচে তরুণদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য। এপ্রিলে পাস হওয়া মোবিলাইজেশন আইন প্রত্যাশিত সংখ্যক সদস্য সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার পর এ চাপ আরও বেড়েছে। এইচআইভি ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তিরাও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে—এই ঘোষণার পরও বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিছু পশ্চিমাপন্থী ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা বয়সসীমা কমানোর জন্যও জোর দিয়েছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জনসাধারণের ক্ষোভের আশঙ্কায় রয়েছেন। যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অনীহা ও অসন্তোষ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও যে তাদের নেতারা এবং সিভিল সোসাইটি এই যুদ্ধকে টিকে থাকার লড়াই হিসেবে তুলে ধরেছে।
প্রায় তিন বছরের পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের পর অনেক ইউক্রেনীয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তবে তাঁদের ক্লান্তি শুধু শারীরিক বা মানসিক কারণে নয়; জাতির সমাজ-রাজনৈতিক ভিত্তিতে আগে থেকেই ফাটল ছিল। যুদ্ধ একে আরও গভীর করেছে।
সোভিয়েত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মতো, ১৯৯০-এর দশকে ইউক্রেনে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্ক দাঁড়ায় এ রকম—রাষ্ট্র তোমাকে সাহায্য করবে না, তবে রাষ্ট্র তোমার ক্ষতিও করবে না। রাষ্ট্র আর নাগরিকের এই দুর্বল সামাজিক চুক্তিকে যুদ্ধ চরম পরীক্ষায় ফেলেছে। যে রাষ্ট্র এত দিন ইউক্রেনীয়দের জীবনে কোথাও কোনো ভূমিকা রাখেনি, হঠাৎ করে সে নাগরিকের কাছে জীবন উৎসর্গ করার দাবি জানাতে শুরু করেছে।
রাশিয়ার প্রাথমিক আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ইউক্রেনজুড়ে ঐক্যের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। ঢেউ উঠেছিল স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের। তবে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক কঠিন বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুদ্ধের বোঝা আর লাভ রাষ্ট্র সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করছে না। সমাজের কিছু অংশ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করছে। অন্য অংশগুলোকে অযৌক্তিক ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। যেমন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার ঘোষণা করে যে ২০২৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ১২ শতাংশে পৌঁছালেও তারা ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বাড়াবে না। এই বাস্তবতা ইউক্রেনের জনগণের বড় অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার যোগ্য সব পুরুষকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছিল। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ পুরুষ তথ্য জমা দিয়েছিল। ৬০ লাখ দেয়নি। এখন পর্যন্ত ইউক্রেন সরকার ৫ লাখ পুরুষের বিরুদ্ধে তথ্য না দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
যুদ্ধের তৃতীয় বছর শেষ হতে চলেছে। এই দুর্বল সামাজিক চুক্তির পরিণতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত একটি জরিপে মাত্র ১০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছিলেন যে তাঁদের বেশির ভাগ আত্মীয় যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত। জুন মাসের আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩২ শতাংশ নতুন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আইন ‘সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সমর্থন’ করেছেন। ৫২ শতাংশ বিরোধিতা করেছেন আর বাকিরা উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
যদিও বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ দেখতে চান। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করতে অনিচ্ছুক। এ কারণেই অধিকাংশ মানুষ যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন জানায়।
ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার যোগ্য সব পুরুষকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছিল। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে মাত্র ৪০ লাখ পুরুষ তথ্য জমা দিয়েছিল। ৬০ লাখ দেয়নি। এখন পর্যন্ত ইউক্রেন সরকার ৫ লাখ পুরুষের বিরুদ্ধে তথ্য না দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
এই বাস্তবতা কেবল জনগণের মনে অনুপ্রেরণার অভাবই নয়, বরং যুদ্ধ কীভাবে শ্রেণি বিভাজনকে গভীরতর করেছে, তা–ও প্রকাশ করে। গত এক বছরে নিয়মিত সংবাদে দেখা গেছে, সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের বিশাল অঙ্কের ঘুষ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে যে তারা এ রকম ঘুষের নগদ ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার করেছে।
২০২২ সাল থেকে রোমানিয়া এবং হাঙ্গেরির সীমান্তে টাইসা নদী পাড়ি দেওয়ার সময় ৪৫ জন ইউক্রেনীয় ডুবে মারা গেছেন। দেশ ছাড়ার চেষ্টা করার সময় নিজের দেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
ফলে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হয়, তারা সাধারণত এতটাই দরিদ্র বা দুর্ভাগ্যবান যে ঘুষ দেওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারেনি। নভেম্বরে এক টিভি সাক্ষাৎকারে একজন সামরিক কমান্ডার বলেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা ৯০ শতাংশই ‘জোরপূর্বক যুদ্ধে আনা গ্রামবাসী’। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনোবল অত্যন্ত নিম্ন। জুলাই মাসে যুদ্ধে যোগ দেওয়া এক ইউক্রেনীয় সাংবাদিক লিখেছিলেন যে তাঁর সঙ্গে থাকা অধিকাংশ যোদ্ধাই গ্রাম থেকে নিয়ে আসা গরিব মানুষ। তারা যুদ্ধের চেয়ে সরকারি দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করতে বেশি আগ্রহী।
যাদের যুদ্ধে আনা হয়, তাদের ওপর হওয়া নির্যাতন মনোবল আরও কমিয়ে দেয়। প্রতি মাসেই মারধরের শিকার হয়ে মারা যাওয়ার কথা শোনা যায়। সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনীয় অফিসার ইউসুফ ওয়ালিদ দাবি করেন যে ৯০ শতাংশ অফিসার নিয়ে আসা যোদ্ধাদের সঙ্গে ‘পশুর মতো’ আচরণ করেন। তাঁর মতে, ১৯৮০ এবং ’৯০-এর দশকে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের ‘দেশপ্রেম’ বলতে কিছু নেই। তাদের একমাত্র চিন্তা অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা।
যখন দরিদ্র গ্রামীণ মানুষদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে, তখন কিয়েভ এবং লভিভের মতো শহরে একটি সচ্ছল নাগরিক গোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত এবং আরামদায়ক জীবন যাপন করছে। এই ‘অভিজাত যোদ্ধা’রা হচ্ছেন অ্যাকটিভিস্ট, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং এনজিও কর্মী। তাঁরা সবাইকে দেশপ্রেমের বয়ান দিয়ে বেড়ান। বলেন যে ইউক্রেনকে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
তবু এই এলিটরা নিজে লড়াইয়ে যোগ দিতে অনিচ্ছুক। এমন অনেক ‘দেশপ্রেমিক’ সাংবাদিক এবং অ্যাকটিভিস্ট আছেন, যাঁরা দেশের সবাইকে যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু নিজে অসুস্থতা বা অন্য কারণে ছাড় নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর জাতীয়তাবাদীরা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক দুরবস্থার কথা এড়িয়ে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সাধারণ ইউক্রেনীয় জনগণকেই দোষারোপ করেন।
ইউক্রেন কেন যুদ্ধে ব্যর্থ হচ্ছে? এর কারণ কেবল রাশিয়ার অতিকায় শক্তি বা পশ্চিমা সাহায্যের অভাব নয়। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে ভিয়েতনামের মতো দেশ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছে।
এই অঞ্চলের অনেক দেশের মতোই, স্বাধীনতার পর ইউক্রেনের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে এলিটরা। তারা জনস্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই কারণেই আজকে ইউক্রেনও তার জনগণকে যুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে অক্ষম। গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখে তা সম্ভবও নয়। বিভক্ত ইউক্রেনীয় জাতিকে সত্যিকার অর্থে একত্র করতে পারে একমাত্র অনুভূতি হলো ভয়। তাদের ভয় নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর, যুদ্ধে বোমা গুলিতে মরার, ভয় বাধ্যতামূলক যুদ্ধে যাওয়ার। সবচেয়ে বড় ভয় এমন যুদ্ধের বলি হওয়ার, যাতে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রতিদিন কমছে। এসব ভয় কখনো জনগণকে একত্র করতে পারে না।
পিওতর কারাতায়েভ সাংবাদিক
ভলদমির ইশচেঙ্কো বার্লিনের ফ্রেইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্ট ইউরোপিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন