মানুষ কেন এভাবে নির্বিকার হয়ে যাচ্ছে

মানবজাতির যে ইতিহাস, তা অলৌকিকতায় পূর্ণ। কিন্তু এই অলৌকিকতার আড়ালে চাপা পড়েছে নিপীড়ন, অত্যাচার, রক্তাক্ত যুদ্ধ, বর্বরতা, খুন ও গণহত্যার গল্প। যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই, তখন আশ্চর্য হই। ভাবি, কী করে এই ভয়াবহ ঘটনা চলতে দিলাম আমরা? কী করে মানুষ এই পরিস্থিতিতেও নির্বিকার ছিল? কী করে বেঁচে ছিল তারা?

পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি অত্যন্ত জটিল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ জুড়ে আছে মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেই বিষয়টি।

জোরালো রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রাণঘাতী সংঘাতের আগেও ধারাবাহিকভাবে কিছু ঘটনা ঘটে। ধীরে ধীরে এসব ঘটনা তীব্রতা পায়। যখন হুমকিগুলো ছোট হয়, আর এর তীব্রতা ক্রমশ বাড়ে তখন মানুষের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া খুব শক্তিশালী হয় না। ফলে প্রতিরোধও হয় দুর্বল ধরনের।

মানুষ পরিস্থিতিকে মেনে নেয়। অপেক্ষাকৃত ধীর গতি থেকে যে বৃহৎ ও ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো নিয়ে মানুষ খুব বেশি আন্দোলিত হয় না; বরং ভবিতব্য বলে ধরে নেয়।

আমাদের একজন নিউরোসায়েন্টিস্ট (স্নায়ুবিজ্ঞানী), অন্যজন আইনের অধ্যাপক। কেন এবং কীভাবে মানুষ নির্বিকার হয়ে গেল তার সঠিক কারণ অনুসন্ধান ছাড়া এই প্রবণতার পেছনে কী কারণ, তা জানা যাবে না।

অভ্যস্ততা আমাদের মৌলিক শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য। আমরা অর্থাৎ দু-পেয়ে, বড় মস্তিষ্কের প্রাণীরা এদিক থেকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী যেমন বানর, হাতি, কুকুর, পাখি, ব্যাঙ, মাছ ও ইঁদুরের মতো। তাই মানুষ জটিল সামাজিক পরিস্থিতি যেমন যুদ্ধ, দুর্নীতি, বৈষম্য, নির্যাতন, সর্বব্যাপী অপ তথ্য এবং চরমপন্থায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

মূল কারণ হলো, আমাদের মস্তিষ্কের একটি জৈবিক বৈশিষ্ট্য। যাকে বলা হয় হ্যাবিচুয়েশন বা অভ্যাস। যেসব ঘটনা আমরা সব সময় ঘটতে দেখছি কিংবা খুব ধীরগতিতে যেসব পরিবর্তন হচ্ছে, তার জবাবে আমাদের মস্তিষ্ক সেভাবে সাড়া দেয় না। ধরুন, আপনি একটা ক্যাফেতে ঢুকছেন। কফির সুগন্ধে দোকান ভরপুর, আপনিও চনমনে হয়ে উঠছেন।

আপনি ক্যাফেতে আরও ২০ মিনিট বসে থাকলেন। সেই সুঘ্রাণ আর পাবেন না। কারণ, ঘ্রাণের অনুভূতিকে যে স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করে, সেই স্নায়ু আর অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ঘ্রাণে সাড়া দেয়নি।

একইভাবে, ধরুন আপনার শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি একঘেয়ে শব্দে চলতে থাকে। কিন্তু একটা সময় আপনি এই শব্দের অস্তিত্বই ভুলে যাবেন। কারণ, মস্তিষ্ক এই শব্দকে গ্রাহ্য করে না। বরং যে শব্দ আপনার শোনা প্রয়োজন, কেবল সে শব্দেই আপনি সাড়া দেবেন। সহজ কথায়, আপনাদের মস্তিষ্ক শুধু পরিবর্তনে সাড়া দেয়, অন্যথায় নয়।

অভ্যস্ততা আমাদের মৌলিক শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য। আমরা অর্থাৎ দু-পেয়ে, বড় মস্তিষ্কের প্রাণীরা এদিক থেকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী যেমন বানর, হাতি, কুকুর, পাখি, ব্যাঙ, মাছ ও ইঁদুরের মতো।

তাই মানুষ জটিল সামাজিক পরিস্থিতি যেমন যুদ্ধ, দুর্নীতি, বৈষম্য, নির্যাতন, সর্বব্যাপী অপ তথ্য এবং চরমপন্থায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অভ্যস্ততার আরও একটি দিক হলো, আমরা শুধু জটিল ঘটনাবলির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, তা-ই নয়; বরং চারপাশে নীতিবর্জিত ঘটনাপ্রবাহের অংশ হয়ে যাই।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শ্যারোর গবেষণায় দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ তার নিজের অসততায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এই গবেষণার অংশ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবীদের মিথ্যা বলার বিনিময়ে টাকা দেওয়া হয়েছিল। মিথ্যা বললে অন্যের ক্ষতি হতে পারে, এমন সম্ভাবনা থাকার পরও। সে সময় তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম রেকর্ড করা হয়।

স্বেচ্ছাসেবীরা শুরু করেছিলেন অনেকটা নির্দোষ মিথ্যা দিয়েই। প্রতারণার বিনিময়ে তাঁরা পাচ্ছিলেন কয়েক সেন্ট করে। ধীরে ধীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একপর্যায়ে তাঁরা বড় অঙ্কের ডলারের বিনিময়ে বড় বড় মিথ্যা বলতে শুরু করলেন।

প্রথম প্রথম মিথ্যা বলার সময় এই মানুষগুলোর মস্তিষ্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছিল, বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা নিজেদের এই অসততায় অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু যখন তাঁরা একের পর এক মিথ্যা বলতে থাকলেন, তখন মস্তিষ্কে আর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। মানুষ মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না হওয়ায়, নিজেদের অসততা নিয়েও তাঁরা আর বিচলিত হলেন না; বরং একের পর এক মিথ্যা বলতে থাকলেন।

আমরা যে শুধু স্বল্প মাত্রার অসততার সঙ্গে মানিয়ে নিই, তা নয়। ১৯৬০ সালে মনস্তত্ত্ববিদ স্ট্যানলি মিলগ্রাম একটি সমীক্ষা চালান, পরে যা বিখ্যাত হয়। ওই সমীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে কর্তৃত্ববাদের উত্থান নিয়ে।

মিলগ্রামের গবেষণার বিষয় ছিল আনুগত্য এবং আনুগত্যের কারণে সাধারণ মানুষ কীভাবে ভয়ংকর সব কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, তার অনুসন্ধান করা। মিলগ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল আনুগত্য-বিষয়ক। তবে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আসলে মিলগ্রামের কাজটাও ছিল অভ্যস্ততা নিয়ে।

তিনি দেখিয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এমনকি সাধারণ নাগরিকেরাও অন্যের শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিয়েছেন। তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে মিলগ্রাম আরও জটিল পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের অন্যের শরীরে স্বল্প মাত্রায় বৈদ্যুতিক শক দিতে বলেন। এরপর ক্রমেই ভোল্টেজ বাড়িয়ে শক দেওয়ার নির্দেশনা দেন। ওই শক একপর্যায়ে অতি উচ্চমাত্রায় পৌঁছায়।

স্বেচ্ছাসেবীদের ভোল্টেজ ধাপে ধাপে বাড়াতে বলে মিলগ্রাম আসলে দেখতে চাইছিলেন তাঁরা নিরাবেগ হয়ে পড়ে কি না বা কোনো অভ্যস্ততা তৈরি হয় কি না। শুরুর দিকে স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ কেউ অপরাধবোধে ভুগছিলেন। কিন্তু তারা যখন ধীরে ধীরে ভোল্টেজ বাড়াতে শুরু করে, তাদের মধ্যে অপরাধবোধের মাত্রাও কমতে থাকে।

যখন তারা তীব্র ভোল্টেজ প্রয়োগ করে, তখনো তারা অবিচল ছিল। যদিও তারা বুঝতে পারছিল তাদের এই কর্মকাণ্ডে মানুষ প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবীদের যদি শুরুতেই এত তীব্র ভোল্টেজ অন্যের শরীরে প্রয়োগ করতে বলা হতো, তারা এটা করত কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।

মিলগ্রামের গবেষণা যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলো ফেলেছে তা হলো, মানুষ কেবল মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না। তারা ভয়ংকর ও নারকীয় ঘটনাতেও আর প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এমনকি এসব কাজে তারা নিজেরা যুক্ত থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।

মিল্টন মেয়ার নাৎসিদের উত্থান নিয়ে লেখা বইতে যাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বলেছিলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাই, সর্বশেষ ঘটনার চেয়ে খারাপ ছিল। খারাপ হয়েছিল অল্প অল্প করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও ওই সরকারের সবশেষ, সবচেয়ে জঘন্য কাজটি প্রথম বা ছোট্ট একটি ঘটনার পরই ঘটত, লাখ লাখ মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ত। কিন্তু ঘটনাগুলো সেভাবে ঘটেনি বা ঘটে না। কোনো ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতির আগে শত শত ছোট ছোট ঘটনা ঘটে, যার কোনো কোনোটি হয়তো কারও কল্পনাতেই আসেনি। প্রতিটি ঘটনা পরবর্তী ঘটনার জন্য আপনাকে প্রস্তুত করে।

আপনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠতে পারেন। শঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক।

যদিও খুব ধীরলয়ে, তবু মনে রাখতে হবে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে অনাচার ও ভীতির বিরুদ্ধে। আপনি ফ্রেঞ্চ রেজিস্টান্সের কথা ভাবতে পারেন। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার কিংবা মি টু—এই সবই উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করুন। এই আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছিল অনভ্যস্ত উদ্যোক্তাদের হাত ধরে।  

যেসব মানুষ সমাজের প্রচলিত অসংগতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ হন, তাঁদের চোখেই অন্যায়গুলো-ভুলগুলো ধরা পড়ে, তাঁরাই অন্যদের অভ্যস্ততার অর্গল ভেঙে বেরিয়ে আসার ডাক দেন। অনেক সময় এই মানুষের বৈষম্য বা অনাচারের শিকার হওয়ার ইতিহাস থাকে। কিন্তু তাঁরা কখনোই তাঁদের অতীত ভুলে যান না।

মালালা ইউসুফজাই, মোহন দাস গান্ধী, রোজা পার্ক, গ্লোরিয়া স্টেইনেম, হার্ভে মিল্ক ও নেলসন ম্যান্ডেলা এই গোত্রভুক্ত। এর বাইরেও আরও অনেকেই আছেন। যাঁরা অন্যের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় চুপ থাকতে পারেন না, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যেমন উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন, রুজভেল্ট ও পিটার  সিঙ্গার।

  • তালি শ্যারোকার আর সানসটেইন ড. শ্যারো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন ও এমআইটির শিক্ষক ও সানসটেইন হার্ভার্ডের আইনবিষয়ক অধ্যাপক। নিবন্ধটি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম