প্রতিবছর জুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার (কদাচিৎ দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার) আমাদের জীবনে একটু চাঞ্চল্য নিয়ে আসে জাতীয় বাজেট। অর্থমন্ত্রী একখানা ব্রিফকেস বগলে চেপে প্রধানমন্ত্রীর পিছু পিছু জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন। তারপর পড়তে শুরু করেন বাজেট। পড়তেই থাকেন, পড়তেই থাকেন। সে এক বিষম বিরক্তিকর পড়া। বেচারা অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের পায়ে খিল লেগে যায়, তা–ও বাজেট পড়া শেষ হয় না।
সেই বাজেট আমাদের জীবনে কী চাঞ্চল্য তৈরি করে? আমরা দেখতে পাই, বাজেটের পর অনেক পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যায়, অল্পকিছু পণ্য কিংবা সেবার দাম আবার কমেও। বাজেট সবচেয়ে অপছন্দ করেন সম্ভবত ধূমপায়ীরা। প্রতিবছর বাজেটের পরপরই সিগারেটের দাম বেড়ে যায়। মুঠোফোনে কথা বলার খরচও বাড়ে প্রতিবছর বাজেটের পর।
২০২৪ সালে বাজেটের পর দাম বেড়েছিল আমসত্ত্ব ও আমের জুসের। বেড়েছিল কোমল পানীয়, আইসক্রিম, এলইডি বাল্ব, এনার্জি সেভিং লাইট, ফ্রিজ, এসি, অ্যামিউজমেন্ট/থিম পার্কে বেড়ানোর টিকিট, ইট, সিসি ক্যামেরা, মোটরসাইকেল, বিদেশি কাজুবাদাম, সুইচ, সকেট, আয়রন, জেনারেটর ইত্যাদি নানা সামগ্রীর দাম।
বাজেটে অল্প কিছু সামগ্রীর দাম কমেছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের ফিল্টার ও সার্কিট। ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কিটের দাম কমেছিল। চকলেট, বিদেশি পোশাক, এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন, এয়ারক্রাফট প্রপেলার, মিথানল ও মাশরুমের দাম কমেছিল।
বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সেবা বা পণ্যের দাম বাড়া কিংবা কমার সম্পর্ক কী
বাজেটে বিভিন্ন সেবা বা পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর বাড়ানো কিংবা কমানো হয়। এ জন্য বাজেট ঘোষণার সঙ্গে পণ্য বা সেবার দামের পরিবর্তন–সম্পর্কিত। আমাদের জীবনে বাজেটের সরাসরি প্রভাব এতটুকুই। তাই সাধারণ মানুষ জুন মাসের দু–চার দিন এ বাজেট নিয়ে আলোচনা করে। কোনো পণ্যের শুল্ক–কর অতিরিক্ত বাড়ানো হলে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। পত্রিকাগুলো বাজেট নিয়ে হেডলাইন করে।
ব্যস, এতটুকুই?
বাজেট নিয়ে আমরা যতটুকু মাথা ঘামাই, এর প্রভাব আমাদের জীবনে তার কয়েক গুণ বেশি।
আসুন, প্রথমে বুঝে নিই, বাজেট জিনিসটা কী?
একটা দেশের বাজেট হলো পরবর্তী এক বছর সেই দেশের সরকার কত টাকা আয় করবে, আর কত টাকা ব্যয় করবে, তার একটা প্রাক্কলন। এই এক বছর সময়কালকে আমাদের দেশে অর্থবছর বলা হয়। একটা ক্যালেন্ডার ইয়ারের ১ জুলাই থেকে পরবর্তী ক্যালেন্ডার ইয়ারের ৩০ জুন পর্যন্ত এক অর্থবছর ধরা হয়। তাহলে কোনো একটা বছরের জুনের প্রথম বিষ্যুদবার কিংবা দ্বিতীয় বিষ্যুদবার অর্থমন্ত্রী মহোদয় সংসদে দাঁড়িয়ে যে বাজেট পেশ করেন, সেটা হলো সেই বছরের ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের সব আয় ও ব্যয়ের প্রক্ষেপণ।
দেশের সরকার একটা বড় সংস্থা। অনেকগুলো সংস্থা মিলিয়ে হয় এই বিশাল সংস্থা। দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী এই সংস্থার চালিকা শক্তি। এই এত্ত বড় সংস্থা দেশকে পরিচালনা করে, দেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। দেশের মানুষকে খাওয়ায়, পরায় আর পড়ায়।
সরকার নামের এত্ত বিশাল একটা যন্ত্র চালাতে এত্ত এত্ত টাকা দরকার। সরকার তাই নানা খাত থেকে আয় করে। আবার নানা খাতে সেগুলো ব্যয়ও করে। এই আয়-ব্যয়ের সব হিসাব অর্থবছরের শুরুতেই করে ফেলেন অর্থমন্ত্রী মহোদয়। এই হিসাবের নাম হলো বুডগেট (Budget), আমরা বলি বাজেট।
সরকার কোথা থেকে আয় করে, জানতে ইচ্ছা করে?
প্রধান কিছু খাতের কথা বলি—
১. মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)।
২. জনগণের আয় ও মুনাফা থেকে কর।
৩. সম্পূরক শুল্ক।
৪. আমদানি শুল্ক।
৫. অন্যান্য আয় (এখানে শয়ে শয়ে আইটেম লেখা যাবে, আপাতত লিখছি না)
তাহলে সরকারের ব্যয়ের খাত কী?
১. ঋণের বিপরীতে সুদ ব্যয়
২. শিক্ষা
৩. ভর্তুকি ও প্রণোদনা
৪. পরিবহন ও যোগাযোগ
৫. জনপ্রশাসন
কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, সামাজিক কল্যাণ, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, পেনশন, গ্রাচুইটি ইত্যাদি নানা খাতে সরকার অর্থ ব্যয় করে।
তাহলে বোঝা গেল, সরকার অনেক খাত থেকে আয় করে, অনেক খাতে ব্যয়ও করে।
এখন একটা সমীকরণ দাঁড় করাই—
সরকারের মোট আয় = সরকারের মোট ব্যয়।
সরকার যা আয় করবে, তার সমান ব্যয় করবে—এ রকমটাই তো হওয়া উচিত, তাই না? আদতে তা হয় না। একটা উদাহরণ দিই:
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
এটা কী হলো? আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি?
পাটিগণিত বলছে, আয়ের চেয়ে মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় করবে সরকার। এই ঘাটতি টাকা পাবে কই থেকে? এই ঘাটতি টাকার একটা ফ্যাশনেবল নাম দিয়েছে সরকার—ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি বাজেট শব্দযুগলের তরজমা করলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এ রকম—এই পরিমাণ টাকা খরচ করবে সরকার, কিন্তু এই টাকার সংস্থান তাদের কাছে নেই। তাই তারা এই টাকা ধার করবে।
ধার না বলে ঋণ বললে আরেকটু জুতসই হতো। ২,৫৬০,০০০,০০০,০০০ টাকা শুধু এক অর্থবছরে ধার করে খরচ করার বাজেট দিয়েছেন বাংলাদেশের সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী মহোদয়। ঋণ করে ঘি খাওয়া—এ রকম একটা প্রবাদ আছে বাংলা ভাষায়। এ প্রবাদের সবচেয়ে সার্থক উদাহরণ বোধ হয় এটাই।
সরকার কার কাছে ঋণ করবে? এই ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ করার পরিকল্পনা করেছিল। এ ছাড়া সরকার সাধারণ মানুষের কাছে সঞ্চয়পত্র বেচে ঋণ করে। নানা বিদেশি সংস্থা ও সরকারের কাছ থেকে ঋণ করে সরকার। এই ঋণ কি এবারই প্রথম করছে সরকার? না।
বাংলাদেশের শুরু থেকেই ঘাটতি বাজেট আর ঋণ হচ্ছে সরকারের অন্যতম চালিকা শক্তি। শুধু বিগত পাঁচ বাজেটের হিসাব বলি:
২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বাজেট ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা, ঘাটতি ১,৪১,২১২ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বাজেট ৫,৬৮,০০০ কোটি টাকা, ঘাটতি ১,৯০,০০০ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বাজেট ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা, ঘাটতি ২,১৪,৬৮১ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বাজেট ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা, ঘাটতি ২,৪৫,০৬৪ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বাজেট ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা, ঘাটতি ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা।
এ তথ্য বোঝাচ্ছে, সরকার যা খরচ করে, তার অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ টাকা আয় না করেই খরচ করে। ঘাটতির ট্রেন্ডটা দেখেন—প্রতিবছর ঘাটতি বাড়ছেই।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়। সে বছর বাজেট ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, মোট ঘাটতি ছিল ২৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। ১৫ বছর পর ২০২৪ সালে বাজেটঘাটতি এসে দাঁড়িয়েছে ২০০৯ সালের মোট বাজেটের দ্বিগুণের বেশি।
ঋণ করে খরচ করলে ক্ষতি কী
প্রথম ক্ষতি, সরকার যে ঋণ করে তার বিপরীতে বিপুল পরিমাণ সুদ ব্যয় করতে হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সুদ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের অর্ধেক সময় পেরিয়ে এখন মনে হচ্ছে সেই ব্যয় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা পেরিয়ে যাবে। সরকার যদি সব টাকা সুদ খাতেই ব্যয় করে ফেলে, তাহলে জনকল্যাণ ও উন্নয়ন করবে কী দিয়ে?
আশঙ্কার কথা, সরকারের মোট ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ মুহূর্তে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ২০ লাখ কোটি টাকা পেরিয়ে গেছে। যে শিশুটি আজ, এ মুহূর্তে জন্ম নিল, তার মাথায়ও এক লাখ টাকার ওপর ঋণ। আগামী দিনের সরকার কি ঋণের সুদ ও আসল শোধ করবে, নাকি দেশের জনগণের প্রয়োজন মেটাবে—এই শাঁখের করাতে পড়তে হবে তাদের। সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশুমার ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যায়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের সব ব্যাংকে জনগণের আমানত বাড়বে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা থেকে সরকার যদি ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কয় টাকা ঋণ পাবে?
বেসরকারি খাত যদি ঋণ না পায়, তাহলে উৎপাদন কমে যাবে। টাকা খাওয়া যায় না। উৎপাদন কমে গেলে জনগণ খাবে কী?
ঘাটতি বাজেটের চাপ সামাল দিতে সরকার টাকা ছাপাচ্ছে। নির্বিচারে ট্রেজারি বিল বা বন্ড বেচে মানি মার্কেট থেকে সব টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে মানি ফ্লো। বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। জনগণের পেটে লাথি পড়ছে।
এই ঘাটতি বাজেটের চক্র থেকে দেশকে বের করে আনতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আমাদের দিকে চোখ রাঙাচ্ছে লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাত।
বিদেশি ঋণের সুদই ঠিকঠাক পরিশোধ করতে পারছি না আমরা। দু–এক বছরের মধ্যে শুরু হবে অনেকগুলো ঋণের কিস্তি এবং আসল পরিশোধ। কোথা থেকে এত ডলার দেব আমরা? এর মধ্যে আমাদের দেশের লোকজন আছেন দাবিদাওয়া নিয়ে। শত-সহস্র দাবিদাওয়ার জোয়ারে আমাদের বর্তমান সরকারের উড়ে যাওয়ার জোগাড়। অর্থনীতি মেরামতে তাঁরা মনোযোগ দেবেন কীভাবে?
চন্দন আজীজ ব্যাংকার