শ্রাবণের বন্যা ভাদ্রে আরও বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে

টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নজিরবিহীন বন্যা দেখা দেয়
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার বৃষ্টি দেখে খুশিতে বাক বাক দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থেকে রিকশা চালাতে আসা হেমন্ত পরামানিক। বিঘাপ্রতি আট হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তিন বিঘা জমি নিয়ে আমন ধানের আবাদ করেছেন তিনি। সেচের পানির খরচ বাঁচবে, সেই খুশিতে তিনি মাথা ঢাকেন না; বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নেন শরীর। এবার বর্ষা দেরিতে এসেছে। পাটচাষিরা চিন্তায় ছিলেন। এত সুন্দর পাট জাগ দেওয়ার পানি নেই। পুকুর ভাড়া করে পাট জাগের কথা আগে কেউ শোনেনি। এবার সেটাই করতে হয়েছে অনেক জায়গায়। বর্ষার পানি খাওয়া আমনকে সেচের পানি দিয়ে মাঠে বসাতে হয়েছে। তবে এবার আর চিন্তা নেই ‘দেওয়া’ (বৃষ্টি) চলবে। হেমন্ত নিশ্চিত।

রিকশায় সহযাত্রী প্রতিভা মুরং তাঁর মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। বন্যা নিয়ে কথা। বান্দরবান শহরে হাফেজঘোনা পাড়ায় তাঁরা থাকেন। দুই দিন ধরে পানিবন্দী। চুলা জ্বলে না। খাওন নেই। মোবাইলের চার্জ নেই। হেমন্ত পরামানিক আমাদের আলোচনায় ঢুকে যান। তাঁর মাথায় আসে না এই লম্বা খরার পর দিন কয়েকের বৃষ্টিতে মানুষের ঘরবাড়ি কেমনে তলায়। ২৮ বছরেও এমন বৃষ্টি হয়নি যে।

আরও পড়ুন

হেমন্ত রিকশা চালাতে চালাতে আমাদের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে হাসেন। তার মানে এমন বৃষ্টি নতুন নয়, ম্যালা দিন আগে হলেও ‘হচে’ (হয়েছে)। তখন কি এত মানুষ ‘ফরসা’(ফাঁকা হওয়া, মৃত অর্থে) হচে? বানে ভাসি গেছে? পানির পথ বন্ধ করে এল (রেল) বানাবা! সড়ক দিবা!! মরার ফাঁদ পাতিছ, বাঁচবে কেমনে?—হেমন্ত মুহূর্তে লাল হয়ে ওঠেন। সব তাঁর কাছে পরিষ্কার। টক শো তঁার নাগালের বাইরে। জলবায়ু পরিবর্তন বা উন্নয়ন সংলাপ তঁার থেকে দূর হনুস্ত। তারপরও মনে হলো হেমন্ত কিছু ভুল বলেননি।

শ্রাবণ–বিপর্যয়ের আর কি কোনো কারণ ছিল?

সুকুমার রায় তাঁর ‘ষোলো আনাই মিছে’ কবিতায় বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই মুখে প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘চাঁদটা কেন বাড়ে-কমে? জোয়ার কেন আসে?’ এ প্রশ্নের জবাব এখন আমাদের সবারই জানা। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে জোয়ার-ভাটা হয়। আর অমাবস্যা-পূর্ণিমায় হয় বড় জোয়ার। এ সময় সূর্য, চাঁদ এবং আমাদের পৃথিবী প্রায় একই সরলরেখায় চলে আসে। অমাবস্যার সময় পৃথিবীর একই পাশে চাঁদ ও সূর্য এবং পূর্ণিমার সময় সূর্য ও চাঁদের মধ্যে পৃথিবী অবস্থান করে। তাই এই দুই সময় সূর্য আর চাঁদের মিলিত আকর্ষণে জোয়ারের সময় জলস্ফীতি আর স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না, আবার ভাটার টানে জলস্তর বেশি মাত্রায় নেমে যায়।

এবার আগস্টের শুরু থেকে টানা বৃষ্টি ছিল, সঙ্গে ছিল এক অন্য রকমের পূর্ণিমা। ১ আগস্টের পূর্ণিমা ছিল সুপারমুন অর্থাৎ স্বাভাবিক পূর্ণিমার চাঁদের তুলনায় ৮ শতাংশ বড় ও ১৬ শতাংশ বেশি উজ্জ্বল। এসব নিয়ে প্রচারমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কাব্য হলেও সুপারমুনের ভয়ংকর দিকটা তেমন প্রচার পায়নি। সুপারমুনের সময় চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকার কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে দেড় মিটার বেড়ে যায়। সঙ্গে লঘুচাপের আসর থাকলে তো কথাই নেই। উজানের পানি তখন সাগর আর নেয় না। দাপটের সঙ্গে কেবলই ফিরিয়ে দেয়। হয়েছেও তা-ই।

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সৈকতে জোয়ারের উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৬ ফুট এবং ১২ দশমিক ৬ ফুট। যেখানে চট্টগ্রামে নিত্য জোয়ারে পানির উচ্চতা থাকে গড়ে ১০ দশমিক ৫ ফুটের কাছাকাছি। অন্যদিকে বরগুনা আর খুলনা উপকূলে এ সময় জোয়ারের উচ্চতা বেড়ে হয়েছিল ১১ দশমিক ৬ ফুট। খুলনা ও বরগুনায় স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা থাকে যথাক্রমে ৯ ফুট ও ৭ ফুটের মতো।

বন্যায় রেললাইনের নিচ থেকে পাথর ও মাটি সরে গিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে রেললাইন। কেঁওচিয়া, সাতকানিয়া
ছবি: জুয়েল শীল

আমাদের দেশের ‘বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই’ মার্কা কর্মকর্তারা সুপারমুনের খবর জানতেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সুপারমুন এলে সাগর যে বেকায়দা রকম খেপে যাবে, মাছ ধরা নৌকা বেসামাল হবে, বাঁধ ভাঙবে, উপকূলের মানুষ ঘরবাড়ি পানিতে তলাবে, মাঠের ফসল ডুববে, এসব কারও অজানা নয়।

আগস্ট ১১, ২০১৪ সালে অন্য এক সুপারমুনে আমাদের উপকূলীয় জনপদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এবার সুপারমুনের ঠেলায় চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধস, দেয়ালধস, বন্যার পানিতে কমবেশি ৪৩ জন নিহত হয়েছেন (প্রথম আলো, ১১ আগস্ট ২০২৩)। তাঁদের মধ্যে ১০ জন শিশু। মুহুরী নদী, বাঁকখালী নদীর বাঁধসহ বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার খবর এসেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা লামা সদরের ৮০ শতাংশ এলাকা তিন দিন ধরে পানির নিচে ছিল। এবার সাতকানিয়ার মানুষও ভুগেছে অভূতপূর্ব ভোগান্তিতে। বান্দরবানের ঢল আগে যেমন একদৌড়ে কেঁওচিয়া হয়ে সাতকানিয়ার সাঙ্গুতে গিয়ে পড়ত, এখন আর তা হচ্ছে না। কক্সবাজার–চট্টগ্রাম রেললাইন এখন কালাপাহাড় হয়ে বাধা দিচ্ছে সেই পানিপ্রবাহকে। কেঁওচিয়ার সাধারণ মানুষ অনেক আগেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। বুয়েটের শিক্ষক এম শামসুল হকের বিশ্লেষণে সেটাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে (প্রথম আলো, ১২ আগস্ট)।

ফাঁড়া এখনো কাটেনি

১ আগস্টের সুপারমুনের পর ৩০ আগস্ট আসছে আরেক পূর্ণিমা (এক মাসে দুটো পূর্ণিমা অবশ্য বাংলা মাসের হিসাবে সেটা হবে ভাদ্রের পূর্ণিমা)। আসন্ন দ্বিতীয় পূর্ণিমাকে বলা হচ্ছে ব্লু মুন। গণনাকারীরা বলছেন, এই সময় চাঁদ নাকি আগের বারের থেকে পৃথিবীর আরও কাছে থাকবে। অর্থাৎ জোয়ার আরও তেজি হবে। এমনিতেই ভাদ্রের পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ারের তেজ অন্য রকম। ভাদ্রের জোয়ার বড় জোয়ার। ‘ভরা ভাদরের’ জোয়ার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে।

আসন্ন ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার প্রভাবে ৩১ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের ১-২ তারিখের (ভাদ্র ১৩-১৫) দিকে আবারও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি ওই সময় বৃষ্টি হয় তাহলে পরিস্থিতি ৩ আগস্ট থেকেও ভয়াবহ হতে পারে এবং দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলগুলো পুনরায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সুপারমুনের সময় ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো পরবর্তী অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের আগে যদি মেরামত করা না হয়, তাহলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলসড়কের নকশা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের বসতে হবে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে। জানতে হবে পাহাড়ি ঢলের পানি নদীতে যাওয়ার গতিপথ। সেই পথ তাকে দিতে হবে। বন্য হাতি চলাচলের রাস্তার মতো নদীও তার পরম্পরা অনুসরণ করে। মানতে হবে নদী আর জলাধার এক জীবন্ত সত্তা।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

    [email protected]