বিএনপির আমলে যারা কিশোর ছিলেন, তারা তো এখন প্রৌঢ় হয়ে গেছেন!

একসময় ঈদ উপলক্ষে অন্তত সৌজন্য রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে পরস্পরকে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো হতো। কার্ড হস্তান্তরের দৃশ্য টিভিতেও দেখানো হতো। কয়েক বছর ধরে সেটা দেখছি না।

এখন ঈদের আগে, ঈদের সময় এবং ঈদের পরে নেতারা প্রায় সব বিষয়ে বাহাসে মত্ত থাকেন। তাঁরা প্রতিপক্ষকে কথার বাণে ঘায়েল করে ‘দেশপ্রেমের’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চান। দেশের মানুষের যে হাজারও সমস্যা, এসব নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই।

ঈদের আগে যে ঘটনাগুলো দেশের রাজনীতিতে মোটামুটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, তার মধ্যে প্রধান হলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি চালু হবে কি না। ছাত্রলীগের নিশি অভিযানের পর সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলাচিঠি পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে, আদালত দুটি বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন বাতিল এবং ছাত্রলীগ নেতার বাতিল হওয়া সিট পুনর্বহাল।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয় ২০১৯ সালের আবরার ফাহাদ হত্যার পর। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়, ছাত্ররাজনীতি চালু হলে আবার কাউকে না প্রাণ হারাতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে।

ছাত্রলীগের অভিযোগ, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকার সুযোগে মৌলবাদী ছাত্র শিবির ও নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীর সেখানে দেশবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে। কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি দেশবিরোধী তৎপরতা চালালে আইনানুগভাবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম আশঙ্কার কথা কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে? কারা দেশবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে?  যদি চিহ্নিত করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তথ্যপ্রমাণসহ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা সরকারের কর্তব্য।

একজন ছাত্রনেতার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন, সেটি স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এর অর্থ সেখানে ছাত্ররাজনীতি করতে বাধা নেই। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি চালু হবে কি না, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা (যার মধ্যে ছাত্রলীগের সমর্থকেরাও আছেন) সিদ্ধান্ত নেবেন। বাইরে থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।

ছাত্রলীগ বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি কোথায় আছে? কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি নেই। নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি করা, যাঁরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে প্রশাসন ও সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান করবেন।

দুটি স্থানেই কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দেখলাম। এই কিশোর গ্যাংয়ের উৎস নিয়েও দুই দলের বাহাস চলবে। সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ নেতারা এই কিশোর গ্যাংয়ের দায় বিএনপির ওপর চাপাতে পারছেন না। কেননা বিএনপির আমলে যারা কিশোর ছিলেন তারা এখন প্রৌঢ় হয়ে গেছেন।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি বা তাঁর সহযাত্রীরা কেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না?

ছাত্রলীগ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চাইছে বলে আদালত তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। একইভাবে যদি তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আরেকটি রিট করেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানাবে। সাধারণ ছাত্ররা কোন ছাত্র সংগঠনের পক্ষে বা বিপক্ষে সেটাও জানা যাবে।

ছাত্রলীগ যখন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির মুক্ত বাতাস প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে, তখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একধরনের দমবদ্ধ অবস্থা চলছে। কোথাও অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কোথাও জবরদস্তি, কোথাও ত্রাসে পরিবেশ।  

২.
সরকারের নেতাদের দাবি, এবার মানুষ খুবই স্বস্তি ও আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে পারছেন।  বিএনপির নেতারা বলছেন,  দেশে এখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে, ঈদ করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা মানুষের নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ব্যর্থ ও নেতা–কর্মীরা হতাশ হয়ে আবোলতাবোল বকছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, একটি রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হলে কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে নেতা–কর্মীদেরই এর দায় নিতে হয়। কিন্তু সরকার ব্যর্থ হলে কিংবা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলে দেশের সব মানুষকেই তার ফল ভোগ করতে হয়।

‘অতি সফল’ সরকারের আমলে কি ব্যাংকিং খাত ভালো চলেছে? শেয়ারবাজারের ধস নামা ঠেকেছে? বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কি বন্ধ হয়েছে? সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে কি দুর্নীতির মাত্রা কমেছে? বিদেশে অর্থ পাচার কি রহিত হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাদের ভাষায় গণবিচ্ছিন্ন বিএনপির সঙ্গে জননন্দিত আওয়ামী লীগের পার্থক্যটা কোথায়?

৩.
ঈদের আগের দুটি ঘটনা আমাদের ভীষণ মন খারাপ করে দেয়। ১০এপ্রিল সকালে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন মেয়র আ জম ম নাছিরের অনুসারী গোলাম রসুল ওরফে নিশানের বাহিনীর হাতে প্রহৃত চিকিৎসক এম কোরবান আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।  পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ‘৫ এপ্রিল নগরীর আকবরশাহ থানার পশ্চিম ফিরোজশাহ কলোনি এলাকায় দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হন তিনি ও তাঁর ছেলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম রসুল নিশানের অনুসারীরা এ হামলা চালান। আগের একটি ঘটনার জের ধরে ৫ এপ্রিল আসর নামাজের পর রানা স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় ইফতারি আনতে যান। এ সময় তাঁকে একা পেয়ে মাহির সামি, আকিব, বগা সোহেল, ফয়জুল আকবর চৌধুরী আদর, প্রিন্স বাবু, আরিফুল্লাহ রাজু, অপূর্ব, সাগর, রিয়াদ, সংগ্রাম ও শাফায়েত মিলে মারধর করেন। এ দৃশ্য দেখে ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে যান বাবা ডা. কোরবান আলী। তখন আকিব, রিয়াদ ও অপূর্ব তাঁর মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে।

নিশান বাহিনির হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে চিকিৎসক বাবা মারা গেলেন। এর পরই  ছেলেই–বা কতটা নিরাপদ। একবার তিনি মাস্তানদের হাতে মার খেয়েছেন, বাবা রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এখন তো বাবা নেই, কে রক্ষা করবে? বাবার অবর্তমানে পড়াশোনাই বা চলবে কীভাবে? যাঁদের বিরুদ্ধে আলী রেজা মামলা করেছেন, তাঁরা আবার তাঁর ওপর হামলা চালাতে পারেন।

অন্যদিকে বগুড়ায় ঘটেছে উল্টো ঘটনা। সেখানে মারধরের ঘটনায় ছেলেকে পুলিশ ফাঁড়িতে নেওয়া হলে বাবা  রাগেবুল আহসান ওরফেরিপু। তিনি বগুড়া–৬ আসনের সংসদ সদস্য। একটি প্রত্রিকা শিরোনাম করেছে, ‘ছোঁ মেরে ছেলেকে নিয়ে গেলেন এমপি।’  কোনো অনুমতি কিংবা ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়নি।

বগুড়ায় আক্রান্ত ও আক্রমণকারী দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের কর্মী–সমর্থক। শাজাহানপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বগুড়া জিলা স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আবির নামের একটি ছেলে মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর পায়ে ধাক্কা দেন। আবির এমপি তনয় প্রতিত আহসানকে ফোন করলে মোটরসাইকেলে কিশোর গ্যাংয়ের ১৫ থেকে ২০ জনকে নিয়ে এসে রাকিবুলকে মারধর শুরু করেন। পরে টহল পুলিশ এসে দুই পক্ষকে ফাঁড়িতে নিয়ে যায়।

খবর পেয়ে বাবা মধ্যরাতে সেই পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেলেকে উদ্ধার করেন। সেখানেও রাকিবুলের সমর্থকেরা প্রতিপক্ষের হাতে বেদম মার খেয়েছেন। এক বাবা পুত্রকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিলেন, আরেক বাবা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছেলেকে সসম্মানে নিয়ে গেলেন।

দুটি স্থানেই কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দেখলাম। এই কিশোর গ্যাংয়ের উৎস নিয়েও দুই দলের বাহাস চলবে। সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ নেতারা এই কিশোর গ্যাংয়ের দায় বিএনপির ওপর চাপাতে পারছেন না। কেননা বিএনপির আমলে যারা কিশোর ছিলেন তারা এখন প্রৌঢ় হয়ে গেছেন।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক