এ বছর এসএসসি পরীক্ষার গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সাধারণ চোখে এটি রীতিমতো ধস! এই অবনমন গ্রহণযোগ্যও নয়। কিন্তু পাসের হার কমবেশি হওয়ার পেছনে এমন কিছু প্রভাবক কাজ করে, যেগুলো বিবেচনায় নিলে পরীক্ষার ফলের সংখ্যাগত হিসাব গৌণ হয়ে যায়।
পরীক্ষকেরা কীভাবে খাতা দেখবেন এর ওপরেও পাস-ফেল নির্ভর করে। খাতা ‘সহজ’ করে দেখার নির্দেশনা দিয়ে অতীতে পাসের হার বাড়ানো হয়েছে। এবার ফল খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ এখান থেকেই বোঝা যায়। বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদে এসেছে, এ বছর উত্তরপত্র মূল্যায়নে অন্যান্য বছরের চেয়ে ‘কড়াকড়ি’ ছিল। আন্তশিক্ষা বোর্ডগুলোর সভাপতিও সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, ‘আমাদের কোনো টার্গেট ছিল না যে পাসের হার এত করব, বাড়াব, নাকি কমাব।’
পাসের হার কমে যাওয়ায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। আগের বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৫ জন। এ বছর এই সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার ১৮ জন। মানে এখানেও সংখ্যা কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭। গতবারের তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ জিপিএ পায়নি।
শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৬৮। এ বছর এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৮৪। অর্থাৎ শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে ১ হাজার ৯৮৪টি। আর ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। পাস না করতে পারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৮৩টি। এবারের পরীক্ষার ফল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে।
ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে ভালো করার কারণে আগের বছর সামগ্রিক ফল ভালো হয়েছিল। এবার ফল খারাপ হওয়ার পেছনে বলা হচ্ছে গণিতের পাসের হার বড় প্রভাব ফেলেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী গণিতেই পাস করতে পারেনি। এর কারণ খুঁজতে হলে পাঁচ বছর আগে করোনার সময়ে যেতে হবে।
এবার যাদের এসএসসির ফল বের হলো, করোনা মহামারির সময়ে তারা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। মূলত এই শ্রেণি দুটিতেই বীজগণিতের অঙ্ক পরিচিত করানো হয়। নতুন ধরনের অঙ্ক বুঝে ওঠার জন্য শিক্ষকের সহায়তা বিশেষভাবে দরকার। কিন্তু সে সময় স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা দিতে পারেনি। ফলে শিখনঘাটতি নিয়েই তারা সরাসরি অষ্টম শ্রেণিতে উঠে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে বসতে হবে। শিক্ষা বা পরীক্ষা-পদ্ধতির বদল হলেই আমাদের দেশে ‘গেল গেল’ রব ওঠে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে পরিবর্তনের বিকল্প নেই। তবে নতুন কিছু করার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। যৌক্তিক সময় দিয়ে এবং কার্যকারিতা যাচাই করেই পরিবর্তনের কাজগুলো করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন দুর্বলতা নিয়ে ওই সময়ে শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন। কীভাবে এই দুর্বলতা দূর করা যেতে পারে, এমন সুপারিশ কোনো কোনো এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সেগুলো বিবেচনায় নেয়নি। কিছু অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দায় সারা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর সরাসরি অনলাইন ও ইউটিউব দেখে লিখে জমা দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান পরীক্ষা ও প্রশ্নপদ্ধতি নিয়েও আপত্তি তোলা হচ্ছে। গতানুগতিক ধারার প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাই করা সম্ভব হয় না। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতিতে তথ্যমূলক প্রশ্নের গুরুত্ব কমেছে। যেসব তথ্য অনলাইনে অনুসন্ধান করে মুহূর্তেই জেনে নেওয়া যায়, সে ধরনের জ্ঞান বা মুখস্থনির্ভর প্রশ্ন পরীক্ষায় রাখার দরকার নেই। বরং প্রশ্নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর বোধগম্যতা, বিশ্লেষণ-ক্ষমতা ও মৌলিকত্ব বের করে আনা দরকার।
আমাদের দেশে শিক্ষা হয়ে পড়েছে নোট আর টিউশননির্ভর। শিক্ষকের দেওয়া নোট কিংবা গাইডের প্রশ্ন বুঝে না-বুঝে মুখস্থ করেই জিপিএ-৫ পাওয়া যায়। জিপিএ-৫ যে সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলেও। সর্বোচ্চ জিপিএধারী লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের পরিকল্পনা দরকার। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য কিছু নির্দেশনা ও কৌশলই যথেষ্ট। একেকটি বিষয়ের প্রতিটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ শিক্ষাক্রমের কোনো লক্ষ্য সামনে রেখে সাজানো হয়। সেই অধ্যায় বা পরিচ্ছেদের উদ্দিষ্ট যোগ্যতা শিক্ষার্থী অর্জন করেছে, এটি নিশ্চিত করেই সামনে যেতে হবে।
নতুন কোনো অধ্যায় বা আলোচনা শুরু করার আগে যাচাই করে নিতে হবে, এটি শুরু করার জন্য শিক্ষার্থী প্রস্তুত কি না। যেমন, দুটি ত্রিভুজের সর্বসমতা প্রমাণ করে দেখানোর আগে বোঝা দরকার শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের ত্রিভুজ সম্পর্কে জানে কি না। আবার বিভিন্ন ধরনের ত্রিভুজের পরিচয় দেওয়ার আগে দেখতে হবে সে বিভিন্ন ধরনের কোণ সম্পর্কে ধারণা রাখে কি না। শ্রেণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলে সবল শিক্ষার্থীরাও তাদের সহায়তা করতে পারে।
প্রতিটি শ্রেণির কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন না করার কারণে শিক্ষার্থীরা পেছাতে থাকে। কোনো শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণির নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করে যদি নবম শ্রেণিতে ওঠে, আর নবম শ্রেণির যোগ্যতা অর্জন করে দশম শ্রেণিতে ওঠে, তবে এসএসসির ফলাফলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটার কারণ নেই।
আমাদের দেশের শিক্ষকেরা শিক্ষাক্রম সম্পর্কে সাধারণত ধারণা রাখেন না। তাঁরা অনেক সময়ে বুঝতে পারেন না ওই অধ্যায়ের লক্ষ্য কী। তাই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় বা পরিচ্ছেদের শেষে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা যাচাইয়ের একটি ছক রাখা যায়। সেখানে লেখা থাকবে, শিক্ষার্থী কোন কোন বিষয় বা কাজের সক্ষমতা অর্জন করলে পরবর্তী অধ্যায়ে বা পরিচ্ছেদে যেতে পারবে। এটা শিক্ষককেও নিশ্চিত করবে তিনি নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পেরেছেন কি না।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে বসতে হবে। শিক্ষা বা পরীক্ষা-পদ্ধতির বদল হলেই আমাদের দেশে ‘গেল গেল’ রব ওঠে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে পরিবর্তনের বিকল্প নেই। তবে নতুন কিছু করার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। যৌক্তিক সময় দিয়ে এবং কার্যকারিতা যাচাই করেই পরিবর্তনের কাজগুলো করতে হবে।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
মতামত লেখকের নিজস্ব
