সংস্কৃতি ও বিনোদন : এ নিয়ে বিভেদ কেন?

বেশ কয়েক দিন ধরে আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে বেশ লেখালেখি ও আলোচনা চলছে। আলোচনার বিষয়বস্তু বেশ অনাকাঙ্ক্ষিত। হাল আমলে এক ব্যক্তির গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি প্রাপ্তি এবং এ বিষয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন ব্যক্তিত্বের  মন্তব্য নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দিন যত অতিবাহিত হচ্ছে, আলোচনার পরিধি তত প্রসারিত হচ্ছে। এ পরিধির মধ্যে উচিত, অনুচিত সব ধরনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে, এমন বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

যে ব্যক্তির উদ্দেশে মন্তব্য করা হয়েছে, তিনি বিনোদনজগতে পরিচিতি পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যিনি মন্তব্য করেছেন, তিনি সাংস্কৃতিক জগতের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। যদিও বিনোদন ও সংস্কৃতির মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে যোগসূত্র রয়েছে, স্বল্প মেয়াদে এ দুই বিষয়কে এক করে দেখা অনুচিত হবে। আর সে কারণে বিনোদনজগতের মানুষদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কুশীলবদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। সংস্কৃতি একটি ব্যাপক বিষয়, যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর ইতিহাস, কৃষ্টি, বিশ্বাস, দর্শন ইত্যাদি প্রকাশ পায়। সংস্কৃতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়, আর সেই শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। বিনোদন ও তার বিভিন্ন মাধ্যম সামগ্রিক সংস্কৃতির একটি অংশমাত্র।

ধৈর্যহারা হয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করাই শ্রেয়। আবার এ কথাও মনে রাখতে হবে যে সময়ে সঙ্গে ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কারণে মানুষের রুচি সদা পরিবর্তিত হচ্ছে। যে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলা হয়েছে, তা যেমন সাধারণ জনগণের চিন্তার খরা আর মননের অপরিপক্বতার বানের ফসল, তেমনিভাবে পরিবর্তিত বিনোদনমাধ্যমগুলোতে সৃজনশীল ও শুদ্ধ বিনোদনের বেদনাদায়ক দীর্ঘ অভাবেরও ফসল

বিনোদনের যে অংশটুকু মানুষের কথা বলে, সমাজের কথা বলে, আর মানুষের মনকে সমৃদ্ধ করে, তাই কালের পরিক্রমায় সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। বিনোদনমাধ্যম বহুকাল ধরেই মানুষের জীবিকার একটি মাধ্যমও বটে। তাই জীবিকার তাগিদে রকমারি বিনোদনের আবির্ভাব হয়েছে। তবে তার সবটাই শ্রোতা বা দর্শক গ্রহণ করেছে, এমনটা নয়। সময়ের আবর্তে আমাদের দেখা কত শত বিনোদনকারীর আবির্ভাব হয়েছে, তার হিসাবে নেই। তবে তাদের সবাই যে আমাদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছে, তা কিন্তু নয়। কালের আবর্তে তারা হারিয়ে গেছে সময়ের গহিনে। আর যারা আমাদের হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করেছে, তারা রয়ে গেছে আমাদের মনে, আর আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ।

বিনোদনজগতের যে ব্যক্তির উদ্দেশে সমালোচনা করা হয়েছে, বিনোদন বিষয়ে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই।  তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এটিও পরিলক্ষিত হয়, তিনি শুদ্ধ বিনোদন জ্ঞানসম্পন্ন কেউ নন। তাই তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পর্বতসম ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ সহ্য করে তিনি তাঁর বিনোদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে মানসিক শক্তি প্রয়োজন, তা তিনি দেখিয়েছেন এবং হয়তো ভবিষ্যতে সে চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তাঁর এ চলার পথে একেবারেই যে ভালো কিছু অর্জিত হবে না, তা আমরা হলফ করে এ মুহূর্তে বলতে পারি না। হয়তো সময়ের পরিক্রমায় তাঁর বিনোদন সত্যিকার অর্থেই দর্শক নন্দিত হতে পারে, যা এখন পর্যন্ত সুদূরপরাহত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাহলে ওই ব্যক্তিকে কেন এমন সমালোচনার মুখোমুখি হতে হলো?

আসলে এ সমালোচনা কোনো অযৌক্তিক বা বিচ্ছিন্ন কারণে নয়। কালের পরিক্রমায় আমাদের সমাজের নৈতিকতা, চেতনাবোধ আর সর্বোপরি শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা বহুবিধ উপায়ে নিরন্তর বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির ওপর বিদেশি সংস্কৃতির অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব নতুন কিছু নয়। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও ব্যবহারের ফলে নিম্নমান ও অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তিকর বিনোদনের প্রসার ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মধ্যে হতাশার উদ্ভব আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। স্বাধীনতার চেতনার একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান ছিল নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ও ধারণ এবং শুদ্ধ দেশীয় বিনোদনের চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সব সাংস্কৃতিক কর্মী আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে এ দেশীয় সংস্কৃতির রক্ষণ ও উন্নয়নে নিরলস কাজ করেছেন বা করে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য আজকের এই অধঃপতন নিশ্চিতভাবেই চিন্তা ও কষ্টের বিষয়। আর এই কষ্ট ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই হয়তো  সর্বজন শ্রদ্ধেয় নাট্যজন এমন মন্তব্য করেছেন।

কিন্তু আমাদের এ কথাও  মনে রাখতে হবে যে পরমতসহিষ্ণুতা আর সবার জন্য সুযোগ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। অন্যের চেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ও যথাযথ সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই; বরং তা থেকে হয়তো কোনো নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদের ভীত বা ধৈর্যহারা হলে চলবে না। আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে।  মনে রাখতে হবে, মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ভুল করতে পারে; কিন্তু সমষ্টিগতভাবে ভুল করে না। নিম্নমানের পরিবেশনা একজন বা দুজনের এক বা দুই দিনের বিনোদনের খোরাক হতে পারে; কিন্তু দিন ফুরালেই তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আমাদের সমাজে নৈতিক ও শুদ্ধ বিনোদনের পাশাপাশি বহুবিধ অনৈতিক ও অশুদ্ধ বিনোদনের অবস্থান সব সময় ছিল। কিন্তু তাই বলে অনৈতিক বা অশুদ্ধ বিনোদন কখনোই আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়নি বা হবেও না।

সুতরাং, ধৈর্যহারা হয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করাই শ্রেয়। আবার এ কথাও মনে রাখতে হবে যে সময়ে সঙ্গে ও নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কারণে মানুষের রুচি সদা পরিবর্তিত হচ্ছে। যে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলা হয়েছে, তা যেমন সাধারণ জনগণের চিন্তার খরা আর মননের অপরিপক্বতার বানের ফসল, তেমনিভাবে পরিবর্তিত বিনোদনমাধ্যমগুলোতে সৃজনশীল ও শুদ্ধ বিনোদনের বেদনাদায়ক দীর্ঘ অভাবেরও ফসল। এ অভাব পূরণের জন্য পরিবর্তনকে স্বীকার করে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বিনোদনের রকম ও মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যাঁরা সংস্কৃতি বোঝেন আর শুদ্ধ বিনোদন সৃষ্টি করেন, তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে কোনো রকম কালক্ষেপণ ব্যতিরেকে। তা না হলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা পরিপূরণে অকালকুষ্মাণ্ডদের দৌরাত্ম্য রোধ করা কালক্রমে দুরূহ থেকে সুদূরপরাহত হয়ে উঠবে।

  • মসফিক উদ্দীন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।