ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত ‘যুব আলোচনা: নাগরিক প্রত্যাশা’ শীর্ষক সম্মেলনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। পাশে আওয়ামী লীগের কাজী জাফরুল্লাহ, বিএনপির সেলিমা রহমান, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম। ১৩ সেপ্টেম্বর, রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচনী-সংকট কাটাতে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে বসতে বললে তাঁরা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আবার কথা কী? নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে, কে আসল, কে আসল না দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়।

আবার বিএনপির নেতাদেরও আলোচনার কথা বললে, তাঁরাও প্রায় একই সুরে কথা বলেন। আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করেই আলোচনায় বসতে হবে।

দুই দলের এই বিপরীত অবস্থান দেখে মনে হতে পারে তাদের মধ্যে কথাবার্তা বোধহয় পুরোপুরি বন্ধ। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। যখন বিদেশি রাষ্ট্রদূত বা উন্নয়ন সহযোগীরা ডাকেন, তাঁরা সহাস্য বদনে সেখানে যান,  কথা বলেন এবং শোনেনও।

আরও পড়ুন

কার ওপর ভরসা করছে বিএনপি

গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এই নীতির মূল কথা ছিল, যাঁরা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবেন, তাঁদের ও পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়া হবে না। এ নিয়ে শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও চাপানউতর শুরু হয়ে যায়। বছর দুই আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‍্যাবের সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সরকার নানা চেষ্ট তদ্বির করেও সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারেনি। এরপরই এল ভিসার খড়্গ।

মার্কিন ভিসা নীতির পর সরকারি দলের নেতাদের কপালে ভাঁজ পড়লেও সেটি বুঝতে দিতে চান না।  তাঁদের দাবি, আওয়ামী লীগ তো একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই চায়। ফলে এই ভিসা নীতি তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। বরং বিএনপি যদি হরতাল-অবরোধ দিয়ে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে এটি তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে।

অন্যদিকে বিএনপির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে বলেই যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি দিয়েছে। বিএনপি তো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে, ফলে তাদের বিরুদ্ধে এই ভিসা নীতি প্রয়োগের প্রশ্নই ওঠে না।

দুই দলের এই বাদানুবাদের প্রেক্ষাপটে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেই মে মাসেই।  তাঁর সঙ্গে তিন দলের নেতাদের প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন দলের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কেন্দ্রীয় নেতা মো. এ আরাফাত। বিএনপির পক্ষে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। আর জাতীয় পার্টির পক্ষে ছিলেন মহাসচিব মুজিবুল হক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল।

আরও পড়ুন

কার ওপর ভরসা করবে আওয়ামী লীগ

বৈঠক শেষে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে পিটার হাসের বার্তা প্রচার করে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করার এই নতুন ভিসা নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য।’

এর অর্থ যুক্তরাষ্ট্র কেবল নির্বাচন নয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ও কম্বোডিয়ায় তারা ভিসা নীতি চালু করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর। বাংলাদেশে ঘোষণা করেছে নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই।

আরও পড়ুন

কে বেশি চাপে-বিএনপি না আওয়ামী লীগ?

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা আর কোনো উপলক্ষে একসঙ্গে বসেছেন বলে মনে পড়ে না। গত বুধবার ‘যুব আলোচনা: নাগরিক প্রত্যাশা’ সম্মেলনে দুই দলের দুই প্রভাবশালী নেতাকে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। সেই অনুষ্ঠানে মূল আলোচক ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। প্রথম আলোর ছবিতে দেখা যায়, পিটার হাস মাঝখানে বসে আছেন, এক পাশে আওয়ামী লীগের কাজী জাফরুল্লাহ, অপর পাশে বিএনপির সেলিমা রহমান। ছিলেন সেখানে  জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমামও।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সভামঞ্চে একসঙ্গে দেখা না গেলেও সংসদে তাঁদের দেখা হয়। সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচির সমালোচনাও করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সেসব সমালোচনা খুব আমলে নেন বলে মনে হয় না। তাঁরা জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল হিসেবে গণ্য করেন। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির নেতারা সে কথা প্রকাশ্যে বলেছেনও।

আরও পড়ুন

মশা, বিএনপি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার ভয়

যুব সমাবেশের উদ্দেশ্য রাজনীতির বিষয়ে তাদের আগ্রহ বাড়ানো। কিন্তু আমাদের রাজনীতির যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা চান না রাজনীতিতে আসুন। সেটা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন। আমাদের যেই গণতান্ত্রিক নেতারা কথায় কথায় সামরিক শাসকদের নিন্দা ও সমালোচনা করেন। তাঁদের আমলে কিন্তু ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন নিয়মিত হতো। ব্যতিক্রমীভাবে ১৯৯১ সালের পর গণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই নির্বাচন আর হয়নি (ডাকসুতে একবার নির্বাচন হয়েছিল)। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—কেউ দায় এড়াতে পারে না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করার কারণ তরুণদের তারা ভয় পায়। আবার ক্ষমতায় ও বিরোধী দলে থাকতে তারা তরুণদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন।

অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, ছাত্র অবস্থায় তাঁরা অনেককে দেখেন যে ১০ বছর আগে যিনি ভ্যানগাড়িতে চড়তেন, রাজনীতি করে তিনি এখন পাজেরো চালাচ্ছেন। ফলে রাজনীতি নিয়ে তরুণদের মধ্যে একধরনের দ্বিধা কাজ করে। রাজনীতির মধ্যে কীভাবে ঢুকবেন, একবার ঢুকে গেলে হয়তো বের হতে পারবেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, এখন দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে তরুণেরা রাজনীতিতে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন—কেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট দিতে পারেননি?

আরও পড়ুন

বিদেশে লবিং ও তদবিরে কি সবকিছুর সমাধান মেলে

ছাত্রাবস্থায় যাঁরা ভ্যানগাড়িতে চড়তেন, তাঁরা এখন পাজেরো চালাচ্ছেন বলে কাজী জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন, তার মধ্যেই ক্ষমতার রাজনীতির স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। রাজনীতি এখন আর দেশ সেবা বা আদর্শবাদ নয়, অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বসেন না। বিএনপির নেতারাও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন না। তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে অনুষ্ঠানে থাকেন, সেই অনুষ্ঠানে যেতে ও কথা বলতে তাঁদের আপত্তি নেই।

আগে দেখতাম আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা দেশের ভেতরে কোনো বৈঠক না করলেও ব্রিটিশ কমন্সসভার আমন্ত্রণে যেতেন। এখন হয়তো বাইরে থেকে ডাক আসে না বলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় বা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে ডাক এলে তারা হাজির হন।  বাইরে যতই আমেরিকাকে গালাগাল করুক না কেন তলে তলে ঠিকই সদ্ভাব রেখে চলেন। আমাদের রাজনীতিকদের দ্বিচারিতার এটা উদাহরণও বটে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি। ই–মেইল: [email protected]

আরও পড়ুন

রাজনীতিতে তরুণদের হিস্যা কোথায়