গত নভেম্বরে আমস্টারডামে যে ইসরায়েলি ফুটবল–ভক্তরা তাণ্ডব চালিয়েছিল এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করেছিল; ডাচ সরকার ও রাজনীতিকেরা সেই তাণ্ডবকারীদের পক্ষ নিয়েছিল। এ ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বদলে ডাচ নেতারা হামলাকারীদের এমন সব বক্তব্য ও প্রস্তাব গ্রহণ করেন, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর।
এ সংঘর্ষের ঘটনাকে ডাচ ডানপন্থী সরকার নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছে। ঘটনার পরপরই তারা এমন কিছু প্রস্তাব আনে, যা মূলত মুসলিম অভিবাসীদের নিশানা করে।
প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্বৈত নাগরিকত্বধারীদের পাসপোর্ট বাতিল করা এবং যাঁরা সাময়িকভাবে বসবাসের অনুমতি নিয়ে আছেন, তাঁদের সেই অনুমতিও বাতিল করা। তবে শর্ত হলো, যাঁদের ‘ইহুদিবিরোধী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, তাঁদেরই এসব শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার সমালোচনাও অনেক সময় ‘ইহুদিবিরোধী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সরকার আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তথাকথিত ‘ইহুদিবিরোধী’ সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা এবং তাদের নিষিদ্ধ করা। ফিলিস্তিনি বন্দীদের সহায়তাকারী নেটওয়ার্ক সামিদুনকে নিষিদ্ধ করা এবং ‘সন্ত্রাসের প্রশংসা’ করা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনাও এই প্রস্তাবগুলোর অংশ।
এখন পর্যন্ত সরকার শুধু একটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছে। তারা ‘ইহুদিবিরোধিতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি টাস্কফোর্স’ গঠন করেছে। বাকি প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হবে কি না বা কখন কীভাবে কার্যকর হবে, তা এখনো দেখা বাকি।
যাঁরা গত ১৫ মাসে জার্মানির কার্যক্রম ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁদের কাছে ডাচ সরকারের বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড অনেকটাই পরিচিত মনে হতে পারে। কারণ, এক বছরের বেশি সময় ধরে জার্মান সরকার শুধু ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তারা মুসলিম, শরণার্থী এবং অভিবাসী সম্প্রদায়কে অপরাধী ও বলির পাঁঠা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা এমন একটি উদাহরণ তৈরি করেছে, যা এখন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ অনুসরণ করা শুরু করেছে।
গত জুন মাসে জার্মান পার্লামেন্ট একটি নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করে। সেখানে নাগরিকত্ব প্রার্থীদের জন্য একটি ‘ইহুদিবিরোধিতা পরীক্ষা’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, যাঁদের ‘ইহুদিবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে বা যাঁরা জার্মানির ‘রাষ্ট্রের নীতি’ অর্থাৎ ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয় বলে বিবেচিত হবেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেমব্রেন্স অ্যালায়েন্সের (আইএইচআরএ) বিতর্কিত সংজ্ঞাকে (যা ইহুদিবিরোধিতার সঙ্গে ইহুদিবাদবিরোধিতাকে গুলিয়ে ফেলে) এই মানদণ্ডের ভিত্তি ধরা হয়েছে।
যদি কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি’র মতো স্লোগান সমর্থন করা কোনো পোস্টে লাইক দেয় বা ইসরায়েলকে শিশুহত্যা করার অভিযোগ করে দেওয়া পোস্টে সাড়া দেয়, তাহলে তার নাগরিকত্বের আবেদন বাতিল করার জন্য সেটাই যথেষ্ট হতে পারে।
জার্মানিতে দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রেও সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই। কারণ, জার্মান আইন অনুযায়ী, নাগরিকত্ব পাওয়ার ১০ বছর পর্যন্ত সেটি বাতিল করার অধিকার সরকারের রয়েছে।
গত অক্টোবরে জার্মান আইনপ্রণেতারা নতুন অভিবাসন নীতিমালাও অনুমোদন করেছেন। এটি রাষ্ট্রকে শরণার্থীদের ‘ইহুদিবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা সাপেক্ষে তাদের শরণার্থী মর্যাদা বাতিল করার ক্ষমতা দিয়েছে।
এ ঘটনাগুলো দেখায়, জার্মান সরকার যেভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন এবং মুসলিম ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করছে, তা এখন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও প্রভাব ফেলছে।
গত নভেম্বরে জার্মান পার্লামেন্ট ইসরায়েলের সমালোচনা করা ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে নিশানা করে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যারা আইএইচআরএ সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ইহুদিবিরোধী’ বলে বিবেচিত হবে বা যারা বয়কট ও স্যাংশন (বিডিএস) আন্দোলনকে সমর্থন করবে, তাদের সরকারি তহবিল সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হবে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে ‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ ব্যবহার করতে এবং ‘ক্রিমিনাল, বাসস্থান, আশ্রয় এবং নাগরিকত্ব আইন’ প্রয়োগ করতে তাদের ‘অ্যান্টিসেমেটিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
এটি সরকারি তহবিলের ওপর নির্ভরশীল নাগরিক সমাজের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলবে এবং শরণার্থী ও অভিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়াতে পারে। ইউরোপিয়ান লিগ্যাল সাপোর্ট সেন্টারের সিনিয়র আইনজীবী নাদিজা সামুর সতর্ক করেছেন, এই প্রস্তাব ‘অভিবাসন আইনকে নির্যাতনের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাকে জোরালো করবে।’
‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার হুমকি জার্মানিতে ফিলিস্তিনি সংহতি আন্দোলনকেন্দ্রিক গ্রুপ এবং সংগঠনগুলোর জন্য নতুন কিছু নয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে তারা ব্যাপক দমন–পীড়ন, পুলিশি সহিংসতা এবং নজরদারির শিকার হয়েছে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে ও প্রতিবাদী অনুষ্ঠানগুলো বাতিল বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শরণার্থীনীতিতে একটি দেশের কঠোর অভিবাসনবিরোধী ব্যবস্থা প্রথমে সমালোচিত হয়, তারপর স্বীকৃত হয় এবং শেষে অন্য দেশগুলোও তা গ্রহণ করে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দমনের ক্ষেত্রেও এমন একটি ধারা দেখা যাচ্ছে। জার্মানির মতো স্বৈরাচারী পথে অগ্রসর হচ্ছে নেদারল্যান্ডস।
গত ডিসেম্বরে ফ্রান্স একটি আইন পাস করেছে। সে আইন সিনেটের অনুমোদন পেলে এমন বিদেশিদের নাগরিকত্ব ও বসবাসের অনুমতি খারিজ করা হবে, যারা জাতি, ধর্ম বা জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হবে।
দুঃখজনকভাবে এসব স্বৈরাচারী প্রবণতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট জনমত সৃষ্টি হয়নি। নেদারল্যান্ডসে সরকারি কর্মকর্তাদের উগ্র ভাষণের পর কিছু প্রতিবাদ হলেও সরকারের অন্য দমনমূলক পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে বড় আকারে আন্দোলন দেখা যায়নি। ইউরোপের অন্যান্য অংশেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে।
জোসেফিন সোলাঙ্কি ট্রান্সন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের ওয়ার অ্যান্ড প্যাসিফিকেশন প্রোগ্রামের প্রকল্প কর্মকর্তা।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ