নারীকে দমন–পীড়নের নতুন পন্থা, কোনো সমাধান নেই?

নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ। গতকাল বিকেলে।

সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। তা হলো, সাইবার বুলিং বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা ও ডিজিটাল নির্যাতন।

সাম্প্রতিক কালে এই প্রবণতা সর্বকালের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যেকোনো ইস্যুতে, যেকোনো উদ্দেশ্যে, যেকোনো মতানুসারী পুরুষেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামলে পড়ছেন নারীর ওপর। নারীকে চুপ করানোর, দমন–পীড়নের আর শাস্তি দেওয়ার এমন সহজ উপায় বোধ হয় আর নেই। কখনো কখনো দল বেঁধে টার্গেট করে কোনো কোনো নারীর ওপর এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে দিনের পর দিন। আর সবচেয়ে বেশি টার্গেট হচ্ছেন রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে সক্রিয় নারীরা।

একশনএইড বাংলাদেশ ২০২২ সালে একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে অনলাইন নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের শিকার হন। নিঃসন্দেহে ২০২৪–এর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকে এ পর্যন্ত এই ভায়োলেন্সের হার সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গণ–অভ্যুত্থানের নারী সমন্বয়ক ও সক্রিয় কর্মীদের আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অকল্পনীয় ও অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছি তখন, এখনো তা–ই দেখছি।

অপর দিকে ছাত্রলীগের নেতারা এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থক হওয়ার কারণে নারী সাংবাদিক, লেখক, অ্যাকটিভিস্টরাও অনলাইন আক্রমণ থেকে বাদ যাননি মোটেও। উভয় পক্ষের পুরুষেরাই প্রতিপক্ষের নারীদের পীড়ন করার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে বেছে নিয়েছেন ব্যাপক হারে। এমনকি প্রতিপক্ষ পুরুষকে ঘায়েল করার বেলায়ও তাঁদের পরিবারের বা ঘনিষ্ঠ নারীদের টার্গেট করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, তাঁদের কারও পুরুষ সহযাত্রী বা পথের সাথিকে এসবের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

একশনএইডের গবেষণা অনুযায়ী, অনলাইন নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক (৪৭ শতাংশ), তারপর মেসেঞ্জার (৩৫ শতাংশ)। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে ফেসবুকে কোনো নারীকে নিয়ে আপত্তিকর, নোংরা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ঘৃণা–বিদ্বেষমূলক কমেন্ট করা (৮০ দশমিক ৪ শতাংশ)।

এর পরেই আছে ইনবক্সে নোংরা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ বা ছবি পাঠানো (৫৩ শতাংশ)। ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ফেক আইডি খুলে হ্যারাসমেন্টের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে নারীদের ফেসবুকের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অনুমতি না নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে এবং বুলিং করা হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ফেসবুক ওয়ালে বা মেসেঞ্জারে ক্রমাগত ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল অ্যাসল্টের হুমকি পেয়েছেন।

ডিজিটাল মব লিঞ্চিংয়ের এই যুগে ধর্ষকামী পুরুষের জন্য কোনো নারীকে অনলাইনে ‘ধর্ষণ’ করা এখন খুব সোজা। হাতের কাছে না পেলেও নারীকে অনলাইনে প্রহার, ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করতে তেমন কিছু লাগে না, একটা ফেসবুক আইডি থাকলেই চলে।

সুদূর সাতক্ষীরায় বসে একটা স্মার্টফোনের মাধ্যমে ঢাকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী বা নারী শিক্ষক, উচ্চপদস্থ নারী, এমনকি নারী উপদেষ্টা যে কাউকে মনের সুখে যৌন নির্যাতন করা যায়। এতে কারও কিছু আসে–যায় না, কারও কোনো বিচারও হয় না, কেউ কোনো প্রতিবাদও করে না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এ থেকে উল্টো ধর্ষকামী আনন্দ পান। অনেকে নিজে নির্যাতন না করলেও এগুলো শেয়ার করার মধ্য দিয়ে আরও বেশি ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বাংলাদেশের মিসোজিনিস্ট পুরুষদের জন্য এমন সুদিন আর কখনো আসেনি।

রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রিটি দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেওয়ার, পিছিয়ে দেওয়ার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষেরা, কখনো কখনো তাঁদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?

অনলাইন হ্যারাসমেন্ট নারীদের কেবল পরিবার ও সমাজের চোখে হেয়, ব্রিবত ও লজ্জিতই করে না, নারীর ওপর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়াবহ। আইইউটি বাংলাদেশ এর গবেষক ড. মো রুহুল আমিন তাঁর ‘কজেস অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস অব সাইবার বুলিং এগেইনস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ: আ কমপ্রিহেনসিভ স্টাডি’–তে বলেছেন অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীরা মানসিক ও ইমোশনাল ডিসট্রেস, ভীতি ও উদ্বেগ, সোশ্যাল আইসোলেশন বা সমাজচ্যুতির দিকে এগিয়ে যান।

একশনএইডের মতে, ৬৫ শতাংশ তীব্র সাইকোলজিক্যাল ট্রমা, বিষণ্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগেন, ৪২ শতাংশ মতপ্রকাশে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার থেকে সরে আসেন, ২৫ শতাংশ আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান হারানোর সমস্যায় ভোগেন। কেউ কেউ হয়তো সেলফ হার্ম এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। নারীর প্রতি সরাসরি শারীরিক সহিংসতা বা নির্যাতনের চেয়ে এই ডিজিটাল নির্যাতন মোটেও ছোট অপরাধ নয়। অথচ এ বিষয়ে আমরা নীরব।

গবেষণা বলছে, অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীদের ৮৫ শতাংশই এ বিষয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ করেননি, আর ১৫ শতাংশ করে থাকলেও খুব কমসংখ্যক নারীই কোনো সুবিচার পেয়েছেন। যে দেশে ধর্ষণেরই বিচার হয় না, সেখানে ডিজিটাল ধর্ষণের বিচার চাওয়া বোকামিই বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সময় এসেছে এ নিয়ে কথা বলার। ঘুরে দাঁড়ানোর।

আরও পড়ুন

এ বছরের ৪ মার্চ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেন যে তিনি ক্রমাগত হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। টানা এসব হুমকির কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কথাও জানান তিনি।

সম্প্রতি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. মাহমুদা মিতু এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আমার ইনবক্সের গালি আর থ্রেট আর মেসেজগুলো যদি দেখাতে পারতাম, তাহলে যেকোনো সুস্থ মানুষ পাগল হয়ে যেত। সেক্সুয়ালি পার্ভাট লোকের সংখ্যা মারাত্মক হারে বাড়ছে।’

শেষ পর্যন্ত তিনি আরও লেখেন, ‘সাধারণ শালীন ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা অরাজনৈতিক মেয়েদের জন্য প্রথম প্রথম এসবে কষ্ট হবে, এরপর কেউ গায়ে মাখবে না। বাংলাদেশের রাজনীতির পথচলা এমনই!’

মনে পড়ে, গত বছর এক সেমিনারে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ফৌজিয়া আফরোজ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতে কম। রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এর ওপর অপতথ্য ছড়ালে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

তিনি দেখিয়েছিলেন, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম বা নির্বাচনের সময় যাঁরা ক্রমাগত অপতথ্যের শিকার হন ডিজিটাল মিডিয়ায় তার শীর্ষ ১০ জনই নারী। ট্রলিং, ডক্সিং, ডিপফেক ছবি ব্যবহার, অন্তরঙ্গ ছবির ব্যবহার, যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ইত্যাদির মাধ্যমে এই নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে নুসরাত জাহান, উমামা ফাতেমারা যেমন অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন, পরবর্তী সময় সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরিন, সাংবাদিক দীপ্তি চৌধুরী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, এমনকি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পর্যন্ত কেউই রেহাই পাননি। যেভাবে অভিনেত্রী বাঁধন সে সময় সহিংস ডিজিটাল ভায়োলেন্সের শিকার হলেন, সেই একইভাবে এই সময় এর বিপরীতে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন বা সোহানা সাবাকে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হতে হলো। এখানে আক্রমণকারীরা ভিন্নমতাদর্শী হলেও নারীর চরিত্র হননের বেলায় সবাই এক।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পুরুষকে আক্রমণ করার সময়ও সংশ্লিষ্ট নারীদেরই টার্গেট করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমনটা আমরা আগে ঘটতে দেখেছি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী বা মেয়র আতিকুলের মেয়ের বেলায়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখন দেখি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মেয়ের ক্ষেত্রেও।

সম্প্রতি তিনি মিডিয়াকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁর পরিবারকে এভাবে আক্রমণ করা হবে জানলে তিনি এই পদে আসতেন না। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে বিশেষ করে টার্গেট হয়েছেন আদৃতা রায়, সেটা তাঁর বাবার পরিচয়ের কারণেই। কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে হেয় করতে চাইলে, সেই পরিবারটির নারী সদস্যকে বেছে নেওয়াটা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রিটি–দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেওয়ার, পিছিয়ে দেওয়ার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষেরা, কখনো কখনো তাঁদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?

এই ভয়ংকর সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারীরা কোথায়, কার কাছে বিচার চাইবেন, যেখানে কখনো কখনো রাষ্ট্র নিজেই এই ধরনের আচরণকে উৎসাহিত করে চলেছে? শুনেছি, দেশে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। আছে ‘সেন্টার ফর ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’–এর ন্যাশনাল হেল্পলাইন। আদৌ কি আমাদের এ ধরনের ডিজিটাল নির্যাতনের বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা আছে এ দেশে? আছে কি নারীদের সুবিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ?

  • তানজিনা হোসেন কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক