স্মার্ট দেশ গড়তে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে প্রয়োজন

বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাত নিয়ে আমি খুবই আশাবাদীদের দলের একজন মানুষ। খাতটি সত্যিকারের শিল্প হয়ে উঠতে পারলে, এটা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় মাধ্যম হতে পারে। ইতিমধ্যে এই খাত সে প্রমাণ দিয়েছে। প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার খাতটি এখন বছরে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার স্থানীয় বাজার তৈরি করেছে।

দেড় দশকের এই ডিজিটাল যাত্রায় এটা অবশ্যই বড় অর্জন। তবে আমাদের সম্ভাবনা কিন্তু আরও অনেক বেশি। অন্তত ভেতর থেকেই আমি সেটা দেখতে পাই। তবে সম্ভাবনার অন্তরায় হিসেবে রয়েছে ব্যবসার তহবিলের সংস্থান। বাংলাদেশে যেকোনো খাতে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্যই এটি বড় এক চ্যালেঞ্জের নাম।

সারা বিশ্বের তরুণ উদ্যোক্তারা দুটি জায়গা থেকে সমর্থন পেয়ে থাকেন। প্রথমত ‘অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর’। যেখানে কোনো একজন বিনিয়োগকারী কেবল আইডিয়ার ওপর দাঁড়িয়ে সুদূর ভবিষ্যতের পানে চেয়ে বিনিয়োগের ঝুঁকি নেন। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ও সরকার থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া। আমাদের দেশে এই দুটিরই অনেক অভাব।

এ অবস্থায় দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যবসা এগিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে এই খাতকে স্বাবলম্বী করতে এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী বড় করতে তাদের বিনিয়োগের আর্থিক সংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট কালচার যেহেতু আমাদের দেশে সেভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি, তাই আমাদের নীতিনির্ধারকদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। অন্তত ব্যাংকগুলোকে এই কাজে উৎসাহী করা যেতে পারে।

২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে অভাবিত পর্যায়ের। তার ওপর দাঁড়িয়ে নানান ডিজিটাল সেবারও প্রসার হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবসাও বেড়েছে। ২০০৮ সালের মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলারের এই খাত এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান এখন ২০ লাখ পেরিয়ে গেছে। সে বিবেচনায়ও এখন দেশের অন্যতম প্রধান খাত।

ফলে নিশ্চিন্ত বলা যায়, খাতটি পোশাক বা ওষুধশিল্পের মতো বৈদেশিক মুদ্রা আনায় বড় একটা ভূমিকা রাখতে পারে। সে জন্য আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থবিষয়ক দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে। আর সেটা সম্ভব কেবল নীতিনির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

নীতিগত কারণেই ডিজিটাল ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় হবে খুব নগণ্য। ফলে এই ডিজিটাল ব্যাংকের পক্ষে এক অঙ্কের সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক তার গ্রাহকদের আর্থিক ফুটপ্রিন্ট দেখে কর্মতৎপরতা করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় ক্রেডিট রেটিং তৈরি করে তারা ঋণ দেবে। ফলে জামানতের প্রয়োজন হবে না। নগদের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আমি বিষয়টি নিয়ে খুবই আশাবাদী আছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিছু খাতে প্রণোদনা দেওয়ার জন্য ঋণের তহবিল করেছে। আমরা আশা করতে পারি, এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্যও তেমন একটা বিশেষ তহবিল করা যেতে পারে। হোক সেটা ১০০ কোটি বা তার চেয়ে বেশি কিছু টাকার। তারপরও সেই তহবিল থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো বড় একটা সমর্থন দিতে পারবে আইসিসি উদ্যোক্তাদের।

সে জন্য ব্যাংকগুলোকে বলেই দিতে হবে যে ক্রেডিট রেটিং দেখে জামানত ছাড়াই যেন তারা এই উদ্যোক্তাদের ঋণ দেন। কারণ, এদের বেশির ভাগেরই দেখানোর মতো জামানত থাকে না। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে এই ঋণের সুদ যেন এক অঙ্কের ভেতর থাকে।

এ ক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি—ডিজিটাল ব্যাংক ও বেসিস। ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে পরিকল্পনা, তাতে সদ্যই শুরু হতে যাওয়া এই কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে এবং একক অঙ্কের সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে।

আমি নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের সঙ্গে আছি। এটির কার্যক্রম এত দ্রুত এগিয়ে চলেছে যে সামনের দিনে উদ্যোক্তারা কেবল ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারবেন। মুঠোফোনে মাত্র কয়েকটা ক্লিকের মাধ্যমেই এটি করা সম্ভব।

নীতিগত কারণেই ডিজিটাল ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় হবে খুব নগণ্য। ফলে এই ডিজিটাল ব্যাংকের পক্ষে এক অঙ্কের সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক তার গ্রাহকদের আর্থিক ফুটপ্রিন্ট দেখে কর্মতৎপরতা করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় ক্রেডিট রেটিং তৈরি করে তারা ঋণ দেবে। ফলে জামানতের প্রয়োজন হবে না। নগদের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আমি বিষয়টি নিয়ে খুবই আশাবাদী আছি।

এ ছাড়া বড় একটি ভূমিকা রাখার কথা বেসিস বা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বৃহৎ এই সংগঠনটির যেকোনো মূল্যে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে উদ্যোক্তাদের জন্য এই আর্থিক সুবিধা বের করে আনতে হবে। কদিন পরই বেসিসের নির্বাচন। সেই ব্যাপারটি বেসিসের নতুন নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারলে আসলেই আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে শিল্প হিসেবে কল্পনা করতে পারি।

আর এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে আগামী দুই মাসের মধ্যে শেষ হতে যাওয়া ট্যাক্স হলিডেকে অন্তত ২০৪১ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা দরকার বলে মনে করি। ট্যাক্স হলিডে উঠে গেলে বাংলাদেশকে আইসিটি খাতের হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে স্বপ্ন, সেটি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়।

কারণ, ব্যবসা পরিচালনার খরচ অনেক বেড়ে যাবে, ফলে প্রতিযোগিতায় আমাদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়বে—এটা একরকম নিশ্চিত। ফলে সরকারকে এটি নতুন করে চিন্তা করার অনুরোধ জানাই।

  • নিয়াজ মোর্শেদ তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং নির্বাহী পরিচালক, নগদ লিমিটেড।