‘আমাকে আপনার কাগজপত্র দেখান’ (শো মি ইয়োর পেপারস)—এই চার শব্দকে জোড়া লাগানোর কাজটা আমরা বিংশ শতকে শিখেছিলাম মূলত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং নাগরিকদের থেকে ‘অন্যদের’ বিচ্ছিন্ন করার জন্য। এর মধ্য দিয়ে আমরা পরিচয়পত্র বা আইডি নম্বরের ধারণা চালু করেছি।
আধুনিক বায়োমেট্রিক ও ডিজিটাল ওয়ালেটভিত্তিক পরিচয় শনাক্তকরণ ব্যবস্থাগুলোকে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার, নাগরিক অংশগ্রহণ সহজতর করার এবং স্বাস্থ্যসেবা ও জনপরিষেবার অধিকতর সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করার উপায় হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
কিন্তু আমরা বিভিন্ন দেশে চালু হওয়া এই প্রযুক্তিচালিত আইডি সিস্টেমগুলোকে ইতিমধ্যে বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাওয়া প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়ার এবং তাদের ওপর নজরদারি করার কাজেই মূলত ব্যবহৃত হতে দেখছি।
উগান্ডার কথাই ধরুন, সেখানে আইডি রোলআউটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশাল প্রশাসনিক সমস্যা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ৫৪ হাজার বয়স্ক মানুষের জীবন রক্ষাকারী সামাজিক সুরক্ষা অনুদান পাওয়ার বিষয়টি আটকে আছে।
আবার ধরুন ভারতের কথা। সেখানে বিপুলসংখ্যক নাগরিকের পরিচয় শনাক্ত করা বায়োমেট্রিক আইডি সিস্টেমের আওতায় ‘আধার কার্ড’ আছে। এই আধার কার্ডের সমস্যার কারণে কোভিড–১৯ মহামারি চলাকালে বহু মানুষ আপৎকালীন খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ে গেছেন।
যারা আপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে চায়, শোষণ করতে চায় এবং ব্যবহার করতে চায়, তাদের জন্য আপনার যাবতীয় তথ্য–উপাত্ত একটি একক শনাক্তকারী যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া একটি পরম উপহার। হতে পারে তারা কোনো সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা কিংবা বেসরকারি কোম্পানি। এর বাইরে উপাত্ত বেহাত হওয়ার ঝুঁকি তো থাকেই।
ফিলিপাইনে কোভিড-১৯ রিলিফ পোর্টালের একটি ত্রুটির কারণে প্রায় তিন লাখ আইডি কার্ড এবং দুই লাখ ফাইল ও চিকিৎসা-নথির ছবি ফাঁস হয়েছে।
ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেমের প্রচারকারীরা যে দাবি করে থাকে, সে বিষয়ে তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। আমাদের অবশ্যই সরকারগুলোর কাছ থেকে তাদের এই ধরনের সিস্টেমের প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্যের উন্মুক্ততা এবং স্বচ্ছতা দাবি করতে হবে।
পাকিস্তানে ফাঁস হওয়া তথ্য প্রায়ই মেয়েদের শনাক্তকরণ, তাদের নিশানা করা এবং হয়রানির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে জাতীয় আইডি ডেটাবেসে প্রায় ৩০০ সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রবেশাধিকার আছে। এতে নাগরিকের তথ্য ফাঁস হওয়ার বিরাট ঝুঁকি আছে।
এই ডিজিটাল পরিচয় ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই কোনো না কোনো বৃহত্তর নজরদারি পরিকাঠামোর হয়ে কাজ করে থাকে এবং আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি আমাদের তথ্যের ওপর নজরদারি করা কর্তৃপক্ষকে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের দিকে পরিচালিত করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়ায়।
আফগানিস্তানে এই ধরনের ব্যবস্থায় সংগৃহীত তথ্য ক্ষমতায় ফিরে আসা তালেবানকে বিরোধিতাকারীদের চিহ্নিত করা, তাঁদের লক্ষ্যবস্তু বানানো ও নিপীড়ন করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, এই ধরনের তথ্য–উপাত্ত সমগ্র জনসংখ্যা নিরীক্ষণ ও গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমনটি অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিরা করে থাকে।
এটি সত্য, ডিজিটাল আইডি স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষায় জনগণের সেবা পাওয়া সহজতর করতে পারে। কিন্তু লোকেরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে—এটি নিশ্চিত না করে যদি এই সিস্টেম ডিজাইন করা হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং অবশ্যই করপোরেট মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেমের প্রচারকারীরা যে দাবি করে থাকে, সে বিষয়ে তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে। আমাদের অবশ্যই সরকারগুলোর কাছ থেকে তাদের এই ধরনের সিস্টেমের প্রকৃত ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্যের উন্মুক্ততা এবং স্বচ্ছতা দাবি করতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডরোথি মুকাসা, লিজা গার্সিয়া ও গাস হোসেইন বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের পক্ষে কাজ করা আন্দোলনকর্মী