ভ্লাদিমির পুতিন

খুব সম্ভবত আমরা কোনো দিনই জানতে পারব না, ভাড়াটে যোদ্ধাদের বাহিনী ভাগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোশিন আসলেই কেন ও কী কারণে নিহত হয়েছেন। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আদেশেই প্রিগোশিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রিগোশিনের শত্রুপক্ষ রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাত ছিল এবং প্রিগোশিনের এই দায়মুক্তিপ্রাপ্ত খুনের ঘটনায় সম্ভবত তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে।

এই হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ পশ্চিমা ভাষ্য প্রিগোশিনের বিষয়ে পুতিনের ভয়, রুশ অভিজাত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং রুশ শাসনব্যবস্থার ভঙ্গুর দিকের ওপর আলোকপাত করেছে।

আরও পড়ুন

পুতিনের জগৎ ছোট হয়ে এসেছে

এসব বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া যে ভুল কিছু, তা মোটেও নয়। কিন্তু এর বাইরে প্রিগোশিনের এই অপঘাতে মৃত্যু রাশিয়ার শাসক গোষ্ঠীর ভেতরে, রুশ সমাজে, সেখানকার মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে এবং রাশিয়ায় কী নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করবে, সেসব তাদের মতামতে বাদ পড়ে গেছে।

প্রিগোশিন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর মধ্যকার প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব মেটাতে প্রেসিডেন্ট পুতিন আরও আগে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রুশ অভিজাত ব্যক্তিরা যে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, সেটি সর্বাংশে সত্য। প্রিগোশিনের সশস্ত্র বিদ্রোহ রাশিয়ার অভ্যন্তরে যে বিভক্তি তৈরি করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা–ও অনেকখানি সত্য।

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটিই এখন প্রত্যেকের চিন্তার কেন্দ্রে আছে।

আরও পড়ুন

পুতিন ও সি চিন মিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলেছেন

সাম্প্রতিক ইউক্রেনীয় আক্রমণাত্মক অভিযানের ব্যর্থতার আলোকে বিচার করলে বলা যায়, যদি রাশিয়ার রাষ্ট্র ও প্রশাসন এক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে রুশ সেনাবাহিনীর এই যুদ্ধে জিতে আসার একটি ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

রাশিয়ার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর আমার ধারণা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এখন যে পর্যায়ে আছে, সে পর্যায়ে যদি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাহলে রাশিয়ার বেশির ভাগ সাধারণ ও অভিজাত লোক সেই প্রস্তাব মেনে নেবেন। এমনকি আমার এটিও মনে হয়েছে যে যদি পুতিন নিজে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন কিংবা এ ধরনের প্রস্তাব এলে তিনি যদি তাতে রাজি হন, তাহলে সাধারণ রুশ নাগরিকেরা পুতিনকে সমর্থন করবেন। কারণ, এখন যুদ্ধবিরতি হলে সেটিকে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখবেন রুশ নাগরিকেরা।

তবে রুশ প্রশাসন ও সামরিক বিভাগে থাকা উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী তাতে গভীরভাবে অখুশি হবে।

আরও পড়ুন

বাইডেনের ধমকিতে পুতিন কেন ভয় পান না

প্রিগোশিনের মৃত্যু, প্রিগোশিনপন্থীদের বিরুদ্ধে পুতিনের নেওয়া কড়া ব্যবস্থা, দুই কট্টর জাতীয়তাবাদী জেনারেলকে অপসারণ এবং সাবেক দনবাস মিলিশিয়া কমান্ডার আইগোর গিরকিনকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অনেকটাই মুষড়ে পড়েছেন।

কিন্তু তারপরও প্রিগোশিনের প্রভাব এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রিগোশিনের প্রশংসা পুতিনকে এখনো ভাবিয়ে তুলছে। প্রিগোশিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কঠোর গোপনীয়তায় সম্পন্ন করাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুতিনের সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার বিষয়টি রাশিয়ার বহু মানুষ সমর্থন করেননি। কিন্তু এখন আবার পুতিন এই যুদ্ধে হেরে ফিরে আসুক, সেটিও তাঁরা চান না।

আরও পড়ুন

পুতিনের ভুল ও এরদোয়ানের চতুরতা

আমি মস্কোর যত অভিজাত ব্যক্তি ও সাধারণ লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের একজনও বলেননি যে রাশিয়ার ক্রিমিয়া ও পূর্ব দনবাস ইউক্রেনের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাঁরা মনে করেন, এই দুই ভূখণ্ডে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব যতক্ষণ ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত গত বছর থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়ার দখল করে নেওয়া অন্য ভূখণ্ডগুলোর দখল ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

রাশিয়ার অভিজাত গোষ্ঠী বা সাধারণ রুশ নাগরিকেরা একধাক্কায়ই সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পক্ষে ছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই যুদ্ধ পুতিনের একক হঠকারী সিদ্ধান্তেই শুরু হয়েছে। তারপরও ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় ও অপমান তাঁরা কেউই চান না।

আরও পড়ুন

পুতিন রাশিয়ায় এখনো কেন এতটা জনপ্রিয়

এটি ইরাক যুদ্ধের সময়কার মার্কিন সেনাদের অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়। ওই সময় অনেক মার্কিন সেনা প্রথমে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানকে সমর্থন দেননি। কিন্তু যখন অভিযান শুরু হয়েই গেল, তখন তাঁরা কেউই সাদ্দাম সরকারের পতন না ঘটিয়ে ঘরে ফেরার পক্ষে ছিলেন না।

এ অবস্থা রাশিয়ার উদারপন্থীদের মহাসংকটে ফেলেছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, ইউক্রেনের মাটিতে যখন রুশ সেনারা নিহত হচ্ছেন এবং রাশিয়াকে পরাজিত করা হবে বলে যখন ইউক্রেন রণহুংকার দিচ্ছে, তখন ইউক্রেনকে সমর্থন না করেও কীভাবে তাঁরা এই যুদ্ধের বিরোধিতা করবেন।

রুশ অভিজাত ব্যক্তিরা মনে করেন, এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় হলে তা অনিবার্যভাবে রাশিয়ায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে; জনগণ খেপে গিয়ে রাস্তায় নামবে ও পুতিনের পতন ঘটাবে। তাঁরা আরও মনে করেন, পুতিনের পতন ঘটলে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • আনাতোল লিয়েভেন কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফটের ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক এবং ‘ইউক্রেন অ্যান্ড রাশিয়া: আ ফ্র্যাটারনাল রাইভালরি’ বইয়ের লেখক