ঋণবিপর্যয় থেকে মুক্তি মেলার পথ কী

মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গত ৩০ বছরের মধ্যে ঋণের বোঝা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।ছবি : রয়টার্স

অনেক উন্নয়নশীল দেশ এখন ঋণসংকটে খাদের কিনারায় পড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোয় আর্থিক সংকোচন—এ সংকট অনিবার্য করে তুলেছে। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু করার আছে। গত মার্চ মাসের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, নিম্ন আয়ের ৬৯টি দেশের মধ্যে ৩৮টি দেশ এরই মধ্যে হয় ঋণবিপর্যয়ে পড়েছে কিংবা উঁচু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গত ৩০ বছরের মধ্যে ঋণের বোঝা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ঋণসংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মহামারি শুরুর পর বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির জোট জি-২০ নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ১ হাজার ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখে। এ ছাড়া ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে জি-৭ এবং ঋণদাতাদের জোট প্যারিস ক্লাবের সঙ্গে যৌথভাবে ঋণসংকটে পড়া দেশগুলো কীভাবে তাদের আর্থিক দেউলিয়াত্ব কাটিয়ে ঋণ শোধ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তার জন্য একটি সাধারণ রূপরেখা প্রণয়ন করে। এ দুটি পদক্ষেপের কোনোটাই উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণসংকট থেকে উত্তরণে যথেষ্ট নয়।

সাধারণ রূপরেখার আওতায় ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো বদনামের ভয়। এর আওতায় কোনো দেশ ঋণ নিলে সেই দেশের ঋণসক্ষমতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হবে। সে কারণে বেশির ভাগ দেশ এ ধরনের ঋণ নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে আগ্রহী নয়। এ ছাড়া এ রূপরেখায় প্রধানত রাষ্ট্রীয় ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কথা বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু ঋণদাতাদের মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মোট ঋণের ৬০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। এ কারণেই সাধারণ রূপরেখার আওতায় ঋণ গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি দেশ আবেদন করেছে।

অবশ্য বিকল্প একটি ভালো পথ রয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মজুত সম্পদ থেকে ৬৫ হাজার কোটি ডলারের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর ঘোষণা করে। এর আওতায় সদস্যদেশগুলোকে নিজ নিজ কোটা অনুযায়ী এসডিআর থেকে ঋণ নিতে পারবে। মূল বিষয়টা হচ্ছে, খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এসডিআর ব্যবহার করা গেলে ঋণগ্রস্ত দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বিপর্যয় থেকে বের হতে পারবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলো তথাকথিত আদি পাপে ভুগছে। এর অর্থ হচ্ছে তারা নিজেদের মুদ্রায় বাইরে থেকে ঋণ নিতে পারে না। এ ছাড়া সার্বভৌম ঋণের রেটিং পয়েন্ট দুর্বল থাকায় তারা আন্তর্জাতিক বন্ড বাজার থেকেও ঋণ নিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে এসডিআর তহবিলের অর্থ দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা সম্ভব। তাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং ঋণসংকট সামাল দেওয়া যাবে।

আমাদের প্রস্তাব হলো, এসডিআর তহবিলে অলস পড়ে থাকা অর্থ ঋণের ভারে ধুঁকতে থাকা দেশগুলোকে দেওয়া প্রয়োজন। এই তহবিলের অর্থ সত্যি সত্যি পার্থক্য গড়ে দিতে পারবে। ২০২১ সালে আইএমএফের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি ট্রাস্ট (পিআরজিটি) থেকে মাত্র ৭৮০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কেউ বলতেই পারেন, একেবারে কিছু না দেওয়ার চেয়ে কিছু অন্তত দেওয়া ভালো। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এটা সামান্য।

প্রকৃত পার্থক্য গড়তে হলে এসডিআর তহবিল অবশ্যই আরও সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো তথাকথিত আদি পাপে ভুগছে। এর অর্থ হচ্ছে তারা নিজেদের মুদ্রায় বাইরে থেকে ঋণ নিতে পারে না। এ ছাড়া সার্বভৌম ঋণের রেটিং পয়েন্ট দুর্বল থাকায় তারা আন্তর্জাতিক বন্ড বাজার থেকেও ঋণ নিতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে এসডিআর তহবিলের অর্থ দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা সম্ভব। তাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং ঋণসংকট সামাল দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এসডিআর তহবিলের ঋণ সদস্যদেশগুলোকে বিনা সুদে দিতে হবে। পিআরজিটি ট্রাস্টের মাধ্যমে অথবা নতুন কোনো নামে এ তহবিলের ঋণবণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো ঋণদাতা ও গ্রহীতাদেশগুলোকে এসডিআর তহবিল থেকে ঋণ পেতে একই সঙ্গে আবেদন করতে হবে। অথবা ঋণগ্রহীতা দেশ শর্ত মেনে আলাদাভাবে আবেদন করতে পারে। কিন্তু আবেদনপ্রক্রিয়া উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর যে ঋণের চাপ তৈরি হয়েছে, তা থেকে শিগগিরই উত্তরণের সহজ পথ নেই। তবে এসডিআর তহবিলের ঋণসক্ষমতা বাড়ানোর এ ধরনের কর্মসূচি দেশগুলোকে আরেকটি বড় ঋণসংকটের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

সি চিয়ান চীনের সোশ্যাল সায়েন্সেস একাডেমির বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির সিনিয়র ফেলো ও উপপরিচালক

ওয়ান তাইলে চায়না বন্ড রেটিং কোম্পানির উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান