এডওয়ার্ড সাঈদের চিন্তা এখনো যে কারণে প্রাসঙ্গিক

এডওয়ার্ড সাঈদ

প্রয়াত ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের বই ওরিয়েন্টালিজম ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ৪৫ বছর কেটে গেছে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত প্রসারিত ‘ওরিয়েন্ট’ বা প্রাচ্যসম্পর্কিত পশ্চিমা উপস্থাপনা বোঝার ক্ষেত্রে এই বই একটি বড় অগ্রগতি এনেছিল। প্রাচ্যসম্পর্কিত যেসব মনগড়া মিথ ও প্রচলিত ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে পশ্চিমা ভাষ্য, মিডিয়া প্রতিনিধিত্ব ও একাডেমিক পাণ্ডিত্য সুদীর্ঘকাল ধরে আধিপত্য জারি রেখেছে, সেগুলোকে শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করার একটি পদ্ধতিগত কাঠামো সাঈদ এই বইয়ে দিয়ে গেছেন।

বইটি প্রকাশের কয়েক দশক পরে পশ্চিমা ভাষ্যের দ্বারা সৃষ্ট স্থায়ী ক্ষতির বিষয়ে নিশ্চিতভাবে অধিকতর সচেতনতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে যে ভাষ্যগুলো ইসলামকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে, সেগুলো সাঈদের মতে, ‘ঔপনিবেশিকতার যুগে উদ্ভূত শক্তির ভাষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়’। এই বিষয়গুলোকে এই বই আমাদের বুঝতে সহায়তা করে আসছে।

তারপরও নাইন–ইলেভেন–পরবর্তী যুগে (যখন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য বর্ণবাদী এবং ইসলামবিদ্বেষী ভাষ্যকে দাঁড় করানো হয়েছে) প্রমাণিত হয়েছে, প্রাচ্য সম্পর্কে পশ্চিমের প্রচলিত ধারণায় আজও খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। প্রাচ্যবাদ হলো ‘ওরিয়েন্ট’ বা প্রাচ্যসম্পর্কিত ইউরোপীয় অপরিহার্যতাবাদী উপস্থাপনাগুলোর (যেগুলোর মধ্যে অন্যান্য সংস্কৃতিকে স্থবির ও একদেশদর্শী হিসেবে বর্ণনা করার প্রবণতা আছে) একটি গঠনমূলক সমালোচনা। এটি জ্ঞান ও ক্ষমতার দ্বিধাবিভক্তির সম্পর্কের বিশ্লেষণ।

প্রাচ্যের ওপর পশ্চিমা আধিপত্য ও কর্তৃত্বের জন্য আদর্শিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার কায়দাকানুন প্রাচ্যবাদ কীভাবে ব্যাখ্যা করে, তা বোঝাতে গিয়ে সাঈদ আরেক বুদ্ধিজীবী মিশেল ফুকোর বক্তৃতা-বিশ্লেষণকে উদ্ধৃত করেছেন। ফুকো ‘ডিসকোর্স’ (‘দার্শনিক ভাষ্য’) পরিভাষাটিকে ‘জ্ঞান ও অর্থ উৎপন্ন করে এমন ঐতিহাসিকভাবে সন্নিবেশিত চিন্তা পদ্ধতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে বিকশিত সামাজিক বিষয়াবলির সামগ্রিক উপলব্ধি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডিসকোর্স তৈরি করা হয়। এই বিষয়গুলো ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাঈদের ভাষ্যমতে, মৌলবাদী এবং প্রাচ্যবাদীদের মূল পার্থক্য ‘আধিপত্য’ ধারণাটির মধ্যে নিহিত। প্রথমোক্তজন, অর্থাৎ মৌলবাদীরা কয়েক শতাব্দীর পরাধীনতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রাচ্যবাদকে একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। আর উদার প্রাচ্যবাদীদের উদ্ভব হয়েছে শতাব্দীব্যাপী আধিপত্যের কারণেই।

প্রাচ্যবাদী ডিসকোর্স বা দার্শনিক ভাষ্য বাইনারি যুক্তিকে তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই ডিসকোর্স যে ‘কল্পনাপ্রসূত ভূগোল’ দ্বারা সমর্থিত হয় তা হলো: ‘আমাদের’ (পশ্চিম) ও ‘তাদের’ (প্রাচ্য)। এটি অন্যকে একটি স্থির সংজ্ঞায় আটকে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে; যার অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রাচ্য’ বলতে সেই সবকিছুকে বোঝায় যার কিছুই পশ্চিমা নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই মূলত প্রাচ্যবাদ সংকটে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সর্বাধুনিক সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পরাধীন মানুষের কথিত অন্তর্নিহিত নিষ্ক্রিয়তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে।

সাহিত্য তাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক উল্লেখ করেছেন, অ-পশ্চিমা নারীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে এমনকি ইউরোপীয় নারীবাদী আন্দোলনগুলো উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক উপস্থাপনা তথা সেই প্রাচীন প্রাচ্য দৃষ্টিভঙ্গি ধরে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুসলিম নারীদের অধীনতা ও তঁাদের স্বাধীনতা অর্জন ও আত্মোপলব্ধি থেকে বিরত রাখার প্রতীক হিসেবে হিজাবের ব্যবহারকে দেখানো হয়ে থাকে। পশ্চিমা এবং মুসলিম সমাজের কোন প্রেক্ষাপটে ন্যায়বিচারের ও স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত নারীরাও হিজাব পরে থাকেন, তা এই ধরনের প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে যায়। কোনো দেশের নারী সরকারপ্রধান যে কনটেক্স বা প্রেক্ষাপটে মাথায় ঘোমটা দেন, সেই প্রেক্ষাপটকেও তঁারা উপেক্ষা করেন।

পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী, সেনেগাল ও মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্বের অন্য মুসলিম নারী রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

পর্দানশিন নারীদের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি একটি বহুরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আবর্তিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পর্দাকে পশ্চিমা চোখে ‘অবমাননা’ হিসেবে দেখা হয় এবং মুসলিম নারীদের একটি পশ্চাদপসরণকারী সমাজের একজন ধর্মান্ধ সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজে তাঁর অবস্থান যা-ই হোক না কেন, তাঁর ‘মুক্ত হওয়া দরকার’ বলে তাঁরা রায় দিয়ে দেন।

রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ওয়েন্ডি ব্রাউন আমাদের মনে করিয়ে দেন, প্রাচ্যবাদী মতবাদ মনে করে, ‘পশ্চিমাদের একটি সংস্কৃতি আছে, অন্যদিকে মুসলমানদের একটি সংস্কৃতি আছে।’ সাঈদ প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতাকে আমলে নিয়েই মুসলিম সমাজের নারী নিগ্রহের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

সাঈদের ভাষ্যমতে, মৌলবাদী এবং প্রাচ্যবাদীদের মূল পার্থক্য ‘আধিপত্য’ ধারণাটির মধ্যে নিহিত। প্রথমোক্তজন, অর্থাৎ মৌলবাদীরা কয়েক শতাব্দীর পরাধীনতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রাচ্যবাদকে একটি হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। আর উদার প্রাচ্যবাদীদের উদ্ভব হয়েছে শতাব্দীব্যাপী আধিপত্যের কারণেই।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

● লরেঞ্জো ফোরলানি ইতালি এবং লেবাননভিত্তিক একজন ইতালীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক