সুদহার বাড়ালে কি মূল্যস্ফীতি কমবে

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে চলে গেলেও সুদের হার বাড়ানোর অস্ত্র প্রয়োগে নীতিনির্ধারক মহল অনীহ
গ্রাফিক্স: প্রথম আলো

সারা দুনিয়াই বলতে গেলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বৈশ্বিক সরবরাহ-শৃঙ্খল ভেঙে পড়া ও কোভিড-পরবর্তী উচ্চ পণ্যমূল্যজনিত সমস্যায় ভুগছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েক মাসের যুদ্ধ কিংবা কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক শৈথিল্যের পেছনে কাজ করলেও সাধারণত মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে উৎপাদন হ্রাস কিংবা আমদানি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটানো বা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়।

অর্থনীতিশাস্ত্রে মূল্যস্ফীতিকে তাই মূলত ‘কস্ট পুশ’ বা ‘ডিমান্ড পুশ’ বলা হয়। তবে ইদানীং বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া অন্য দিকে কোভিডে অনেকের আয় কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি অনেক প্রতিকূল বলে অনেকেরই ধারণা। উন্নত দেশগুলোতে এই পরিস্থিতিতে প্রায় সবাই সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে সফল হলেও বিকাশমান বা উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে শুধু এক দাওয়াই দিয়ে পুরো ফল মিলবে না বলেই আমরা ধারণা করছি।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কের ঘরে চলে গেলেও সুদের হার বাড়ানোর অস্ত্র প্রয়োগে নীতিনির্ধারক মহল অনীহ। অন্য দিকে এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে যদিও পরপর তিনবার নীতি সুদ বা রেপোর সুদহার (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ ধার করার পদ্ধতি বা হার) বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। শুধু তা-ই নয়, বাজারে মুদ্রা সরবরাহও কমেনি। উপরন্তু, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। এ কারণে গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন

সরকারি হিসাবেই গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৯ শতাংশের ওপর; আর সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে প্রায় সবাই মনে করেন, ভোক্তাদের বাস্তবে খরচ বেড়েছে আরও অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ইতিমধ্যে আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তারাও বলছেন, ডলারের দাম ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে এখন যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট সুদহারের মধ্যে থেকে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তো ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ক্ষুদ্র আমানতকারীদেরও প্রচুর সমস্যা হচ্ছে।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, এহেন পরিস্থিতিতে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া অথবা সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত বৈঠকও করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেকেই বলছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়েছে ব্যাংক খাতে। ব্যাংকগুলোর আমানতসহ সবকিছুতে খরচ বেড়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো রেট বাড়ানো হয়েছে, আন্তব্যাংক রেট বেড়েছে। ডলারের রেট বেড়েছে। তথাপিও ঋণের সুদের হার বাড়ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছে। এ জন্যই হয়তো ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

কিছুদিন আগেও অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনরা ৬-৯ বা ৭-১১ সুদহার সীমা তুলে দিলে উদ্যোক্তাদের খরচ আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, এতে করে ব্যাংকেরও তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ বৃদ্ধি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান নিজেই বলেছিলেন, তাঁরা উদ্যোক্তাদের কম খরচে ঋণ দিতে চান, যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে। অর্থনীতির ক্ষুধার্ত খাতগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদেরা বরাবরই বলে আসছিলেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মধ্যে ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণেই মূল্যস্ফীতি বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমরা আগেই বলেছি, অর্থনীতির ওপর এখন যেভাবে চাপ তৈরি হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বেঁধে রাখা ঠিক হচ্ছে না। এ ছাড়া ব্যাংকে আগের মতো উদ্বৃত্ত অর্থও নেই। মানুষ আমানত তুলে নিচ্ছে। জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে, নিম্ন ও সীমিত আয়ের অনেকেই সঞ্চয় হারিয়েছে বা ভেঙে খাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে আবার আমদানি ও রেমিট্যান্স দায় নিষ্পন্নের জন্য নিয়মিত ডলারও কিনতে হচ্ছে। তাই তাদের সব কাজে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাদের সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। একইভাবে অন্যদেরও ঋণের সুদহার বাড়াতে দিতে হবে।

সুদ বা মুনাফা নির্ধারণে আগের ৩ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি হারকে বিবেচনায় নিতেও ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার মূল্যস্ফীতি হার অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম নির্ধারণ করা যাবে না

গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ ও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থে ৩ মাস ও এর বেশি মেয়াদের আমানতে সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোকে বলতে গেলে ৯ দশমিক ১০ শতাংশের বেশি হারের সুদে আমানত সংগ্রহ করার কথা। অন্য দিকে আবার আগের নির্দেশনা অনুসারে তাদের ঋণ বিতরণ করতে হবে ৯ শতাংশের কম সুদে।

সুদ বা মুনাফা নির্ধারণে আগের ৩ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি হারকে বিবেচনায় নিতেও ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যক্তিপর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসরোত্তর পাওনাসহ বিবিধ পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফা হার মূল্যস্ফীতি হার অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম নির্ধারণ করা যাবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সুদহার নির্ধারণ যখন করে দেয়, তখন ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৬৪ শতাংশ। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি, সেপ্টেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯.১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অথচ ব্যাংক ঋণের সুদহার একই রয়ে গেছে। আগেই বলেছি, মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে চার মাসের মধ্যে তিনবার রেপো রেট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও অনেকেই বলছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়িয়ে নীতি সুদহার বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো উপকারে আসছে না।

অনেকেই বলছেন, ঋণের সুদহার বাড়লে, তা বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে ভূমিকা রাখবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ সীমা বহাল থাকার নির্দেশনায় রেপোর কারণে ব্যাংকের অর্থ ধার নেওয়ার খরচ বাড়লেও গ্রাহকদের ঋণ পেতে সুদহার ৯ শতাংশের বেশি দিতে হচ্ছে না। ফলে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। অপর দিকে আমানতে সুদহার বাড়াতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী আমানত আসছে না। এতে কমে আসছে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য। গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায় নেমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে তা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। আগস্টে কমেছে আরও ১৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সরকারের উচ্চ মহলের পরামর্শেই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিলে সুদহারে ‘নয়-ছয়’ সীমা বেঁধে দেয়। ৯ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ দেওয়া যাবে না বলে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, যা এখনো বহাল। কিন্তু অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে বেঁধে দেওয়া সুদহারে ‘নয়-ছয়’ সীমা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এমনকি ঋণও আকাঙ্ক্ষিত খাতে যাচ্ছে না।

কেউ কেউ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রেপো রেট বাড়ানো হলেও এতে শুধু কলমানি মার্কেটে সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে আরেকটু বাড়বে। আর কোনো প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখানে অদ্যাবধি কোনো পরিবর্তন আনেনি। এটি বাড়ালে বা কিছুটা শিথিল করে ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ বা ১৫ শতাংশ করলে ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ বাড়ত। তখন তারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে যেত। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসত।

আরও পড়ুন

অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ২ বছর পর গত ২৯ মে প্রথম রেপো সুদহার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করে। এরপর ৪ মাসের মধ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বার আরও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নিয়ে যায়। আমরা জানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে, যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে। তবে ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণে টাকার প্রবাহ কমছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.০৭ শতাংশ, যা গত প্রায় ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সন্দেহ নেই কিছু উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই এখন মূল্যস্ফীতির ভয়ানক চাপে আছেন। এই চাপ থেকে ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছেন।

তবে সুদহার বাড়ালেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, এত সরল সমাধানে বিশ্বাস কম রাখাই ভালো। অন্য প্রায় সব দেশের মতো মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সুদের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে, তবে সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ-শৃঙ্খল উন্নতকরণ, বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, যথাসময়ে পণ্য আমদানিতে দক্ষতা, উৎপাদকদের ন্যায্যমূল্য প্রদান, সঠিক সময়ে সার-বীজ ও সেচের ব্যবস্থাসহ বাজার ব্যবস্থাপনায়ও সৌকর্য দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে বৃহৎ খাদ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্থায় নিয়েও কাজ করতে হবে।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।