নারীর অধিকারে সংস্কার না আপস?

এই প্রশ্ন করতেই হয় যে, নারীর অধিকার ও জেন্ডার সমতা বিষয়টিকে কি আবারও ‘বিচ্ছিন্ন আলোচনা’ হিসেবে আলাদা করে দেওয়া হলো?

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় তিনটি প্রধান প্রতিশ্রুতি নিয়ে—নিহত, গুমের শিকার ও আহত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; বৈষম্য দূর ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার গ্রহণ করা; এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এর মধে৵ ‘সংস্কার’ ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে জোরালো কর্মপ্রতিশ্রুতি। দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুতই একের পর এক সংস্কার কমিশন গঠনের ফলে জনমনে প্রকৃত পরিবর্তনের ব্যাপারে গভীর প্রত্যাশা তৈরি হয়।

নারীবাদী আন্দোলন এটিকে দীর্ঘদিনের সমতার দাবি ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য দূর করার একটি বিরল সুযোগ হিসেবে দেখেছিল; কিন্তু নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন থেকে সুপারিশ বাস্তবায়নে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে? সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কাঠামোগত বাধা, কর্মপ্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত পদক্ষেপ ও সুপারিশ বাস্তবায়নে অবহেলার ফলে নারী অধিকার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে এবং আবারও কিছু নির্দিষ্ট কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও নারীদের প্রত্যাশা

২০২৪ সালের আগস্টে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে একটি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব ওঠে এবং নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় দফায় গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী এবং সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিটি এজেন্ডাই নারীদের প্রভাবিত করছে, তাই এ ধরনের কমিশন কেবল সময়োপযোগীই নয়; বরং অপরিহার্য ছিল। তবে গঠনের শুরুতেই কমিশনকে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মপরিধি ধরিয়ে দেওয়া হয়। গেজেটে উল্লেখ ছিল, ‘সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার’–এর লক্ষ্যে এই কমিশন সুপারিশ করবে, যা একটি সময়সাপেক্ষ ও বিস্তৃত কাজ। কারণ, জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করার দায়িত্ব তাদের কাঁধে দেওয়া হয়েছিল।

অপর দিকে উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভেবে দেখেনি কীভাবে নারীর অধিকার সংস্কারের মূলস্রোতে আনা যায়। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের কর্মপরিধিতে নারী অধিকার বা নারী-পুরুষ সমতার কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল না। এতে নীরবে এক ধারণা তৈরি হয় যে নারীর বিষয়গুলো শুধু নারী কমিশনই দেখবে (যা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দুটি সংস্কার কমিশনের সদস্য উল্লেখ করেছেন) এবং অন্য কমিশনগুলো মনোযোগ দেবে কেবল ‘রাষ্ট্র’ বা ‘আনুষ্ঠানিক’ সংস্কারে।

এ পৃথক্‌করণে একদিকে নারীর প্রসঙ্গ রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনায় বাদ পড়ে যায়, অন্যদিকে সীমিত সামর্থ্যের নারী কমিশনের ওপর চাপানো হয় পুরো সমাজকে উদ্ধারের অযৌক্তিক দায়িত্ব। নারী কমিশন বেশ কিছু মৌলিক ও র‍্যাডিক্যাল সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। নারীর ক্ষমতায়নকে কেবল স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শ্রমবাজারের মতো খাতে সীমিত না রেখে তারা সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কারের মতো ক্ষেত্রেও সমতার দাবি তোলে। তবে সরকার ভেবে দেখেনি এসব প্রস্তাব কীভাবে আলোচনায় যুক্ত হয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। ফলে সুপারিশগুলো সংহত করার কোনো প্রক্রিয়া তৈরি হয়নি। ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সরকার প্রথমে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও দেশের বাস্তবতায় বিশেষ করে রক্ষণশীল মহলের প্রতিক্রিয়া তারা অনুমান করতে পারেনি, যা তাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির ঘাটতি প্রকাশ করে।

স্বল্প সম্পদ, বিচ্ছিন্নকরণ ও রাজনৈতিক অবহেলা

গত দেড় দশকে সরকারের কাছে নারী আন্দোলনের সরাসরি দাবি তোলার সুযোগ ছিল সীমিত। আগের সরকার নারীর ক্ষমতায়নের স্লোগান দিলেও তা থেকে গেছে প্রতীকী (টোকেনিস্টিক); আইন ও নীতি প্রণীত হলেও দুর্বল বাস্তবায়ন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদে তা ব্যাহত হয়েছে। এ অবস্থায় নারী কমিশনের গঠন নীতিগতভাবে এমন এক পথ উন্মোচন করে, যার মাধ্যমে আন্দোলনের দাবি রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারত এবং কেবল প্রতীকী পদক্ষেপ নয়, বাস্তব পরিবর্তনের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল।

তবে বাস্তবে তা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো একীভূত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘ঐকমত্য কমিশন’ উভয়েই বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। নারীর অধিকার ও নারী-পুরুষ সমতা দেশের অন্যতম বিতর্কিত জনসমস্যা হলেও এ নিয়ে কোনো বৃহত্তর আলোচনা হয়নি; কিংবা জাতীয় ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়ায় নারী কমিশনের সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সংসদে নারীর সংরক্ষিত আসন প্রসঙ্গ, যা কেবল সংবিধান সংস্কারের অংশ হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিল।

এমনকি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলেও সরকার প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। ৪২৩টি প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র তিন-চারটি নিয়ে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর আক্রমণ হয়, কমিশন ও সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা হয় এবং কমিশন বাতিলের দাবি ওঠে। তবুও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ধরনের আক্রমণের নিন্দা করেনি বা সুরক্ষা দেয়নি, কেবল নাগরিক সমাজের চাপের পর দেরিতে দায়সারা বিবৃতি দিয়েছে। এতে প্রশ্ন জাগে—সরকার কি জেন্ডার সমতা ও সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, নাকি জনপ্রিয়তা রক্ষায় সংবেদনশীল ইস্যু এড়িয়ে যাচ্ছে?

ভাঙা প্রতিশ্রুতি ও অনাকাঙ্ক্ষিত টোকেনিজম: নারী অধিকার কি প্রান্তিক হয়েই থাকবে?

এই প্রশ্ন করতেই হয় যে, নারীর অধিকার ও জেন্ডার সমতা বিষয়টিকে কি আবারও ‘বিচ্ছিন্ন আলোচনা’ হিসেবে আলাদা করে দেওয়া হলো? সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো কীভাবে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফলোআপ ও সহায়তা ছাড়া নারী কমিশনের সুপারিশগুলো জাতীয় আলোচনায় জায়গা পাবে না, ফলে প্রতিবেদনটি উপেক্ষিতই থেকে যাবে।

নারী কমিশনের অনেক সুপারিশ বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় আইন, নীতিমালা ও কর্মসূচির ভেতরেই পড়ে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সামান্য উদ্যোগ যেমন প্রজ্ঞাপন জারি করাই যথেষ্ট। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর একক দায়িত্ব না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা নিজেরাই সংস্কার কার্যকর করবে। সে অনুযায়ী প্রতিটি কমিশন চিহ্নিত করেছিল, কোন কাজগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবিলম্বে করতে পারবে।

কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপারিশগুলো আলোচনায় তোলা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। পরবর্তী সরকারের আলোচনার ও সিদ্ধান্তের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সুপারিশগুলো পৌঁছে দেয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া নারীর কণ্ঠস্বর উপেক্ষিত থাকাটা ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

কেউ অনিচ্ছাকৃত উপেক্ষা বলতে পারে; কিন্তু যখন বাস্তব সংস্কারের এই ঐতিহাসিক সুযোগ হারিয়ে গেল, তখন সেই “সদিচ্ছা”রই বা কী মূল্য রইল? ফলাফল দাঁড়িয়েছে—সংস্কারের নামে টোকেনবাদ। রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ, বিতর্কের ভয়, কিংবা জনতুষ্টির কাছে নতি স্বীকার—এসবই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতিকে ছাপিয়ে যায়, এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও।

নারী হিসেবে আমাদের কি বারবার একই দৃশ্য দেখতে হবে? রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের প্রয়োজনের কথা ভেবে সব সময় জনপ্রিয়তাবাদীই থাকবে; কিন্তু সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে এমন জনতুষ্টিমূলক আচরণ প্রত্যাশিত ছিল না।

ইফফাত জাহান ও মাহীন সুলতান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (বিআইজিডি) কর্মরত।

সোহেলা নাজনীন যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে (আইডিএস) কর্মরত।

  • মতামত লেখকদের নিজস্ব