শ্রীনিবাসন–ইলন মাস্ক কেন সরকারপ্রেমী হয়ে গেলেন

ইলন মাস্কও একসময় ব্যক্তির ওপর নজরদারির বিরুদ্ধে ছিলেনছবি: রয়টার্স

শতকোটিপতি প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী বালাজি শ্রীনিবাসন ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী ‘ক্রুসেডার’ হিসেবে খুব নাম কামিয়েছিলেন। ওই বছর শ্রীনিবাসন এক বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘জাতিসমূহের মাইক্রোসফট’ হিসেবে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণকেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির ‘চূড়ান্ত বিদায়’ ‘অবধারিত ও অনিবার্য’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

২০১৩ সালে ওই বক্তৃতা দেওয়ার পরের বছরগুলোয় শ্রীনিবাসন তাঁর প্রযুক্তি-স্বাধীনতাবাদী বার্তাকে দ্বিগুণ জোরে প্রচার করছিলেন। তিনি মার্কিন সরকারের প্রতি তাঁর অবজ্ঞাসঞ্জাত বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এসব বক্তৃতায় তিনি প্রায়ই একটি ‘নেটওয়ার্ক স্টেট’ গঠনের বা একটি নতুন ধরনের রাজনীতির কথা তুলে ধরছিলেন, যেখানে মালিকানা, সম্মতি ও চুক্তির মাধ্যমে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তারপর ২০১৭ সালের শুরুতে এসে দেখা গেল, শ্রীনিবাসন তাঁর টুইটারের এসব বক্তব্যসংবলিত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন। এরপর বালাজি শ্রীনিবাসনের কী যেন হয়ে গেল। দেখা গেল, ফেডারেল সরকার শ্রীনিবাসনের প্রযুক্তি দক্ষতার সাহায্য চাইতে তাঁর দরজায় কড়া নাড়ছে। ওই সময়ের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মন্ত্রিসভা গঠনে সহায়তা করার জন্য শ্রীনিবাসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী ও শ্রীনিবাসনের মতোই স্বাধীনতাবাদী প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী পিটার থিয়েলকে দলে ভিড়িয়ে ফেলেন। এমনকি শ্রীনিবাসনকে ট্রাম্প তাঁর খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করছিলেন।

দেখা গেল, বছরের পর বছর যে পুরোনো আমলের গৎবাঁধা রাজনৈতিক ক্ষমতার সমালোচনা করে শ্রীনিবাসন একটি সরকারবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন, সরকারি বাণে বিদ্ধ হয়ে তাঁর সেই ভাবমূর্তি কোথায় উবে গেল। এটি আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আসলে এটি নতুন ধরনের ভণ্ডামি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শ্রীনিবাসনের মতো প্রযুক্তি-স্বাধীনতাবাদীরা মার্কিন সরকারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার জন্য লাইন ধরে দাঁড়াচ্ছেন। আসলে হচ্ছেটা কী? এটি কি কেবল খামখেয়ালি ধরনের কিছু, নাকি এটি গভীর কোনো অর্থবাহী যুক্তির প্রতিফলন?

এর উত্তর ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটি হলো, সিলিকন ভ্যালির শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি-স্বাধীনতাবাদীরা কেবল ততক্ষণই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে থাকেন, যতক্ষণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাঁরা ব্যক্তিগত সুবিধা পান না। যখন তাঁদের সামনে সরকারের প্রধান মক্কেল হওয়ার সম্ভাবনা এসে দাঁড়ায়, তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে থাকা তাঁদের একসময়ের নীতিগত অবস্থান বিলুপ্ত হয়ে যায়।

মাস্ক এখন তাঁর পোর্টফোলিওর অধিকতর শক্তিশালী যে দুটি উপাদানের ওপর নির্ভর করেন, তার একটি হলো স্পেসএক্স (যা ইউএস স্যাটেলাইটের প্রাথমিক উৎক্ষেপক) এবং আরেকটি হলো স্টারলিংক (যার স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে)। এই উদ্যোগগুলো এখন সরাসরি সরকারগুলোর হয়ে কাজ করছে।

এই রূপান্তর সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায় থিয়েলের মধ্যে। ২০০৯ সালে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বাধীনতাবাদীদের প্রধান কাজ হচ্ছে যেকোনো আদলের রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখা।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, ২০১৬ সালে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে রীতিমতো বক্তৃতা দিয়ে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেললেন। এর পরের বছরগুলোয় ডেটা বিশ্লেষণকারী সংস্থা প্যালান্টির (তিনি সংস্থাটির সহপ্রতিষ্ঠাতা) সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে বিশাল বিশাল অঙ্কের ঠিকাদারি কাজ নিয়ে ফুলেফেঁপে উঠল। এখন এই প্রতিষ্ঠানের সারা বছরের আয়ের অর্ধেকই আসে সরকারি কাজ করার মাধ্যমে।

স্বাধীনতাবাদীদের এই চরিত্র বদলানোর অভ্যন্তরীণ যুক্তিটি থিয়েলের প্রকাশিত একটি লেখার অংশ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত জেমস ডেল ডেভিডসন ও উইলিয়াম রিস-মগের লেখা দ্য সভারেন ইনডিভিজ্যুয়াল: মাস্টারিং দ্য ট্রানজিশন টু দ্য ইনফরমেশন অ্যাজ বইটির একটি নতুন ভূমিকা ২০২০ সালে লিখেছিলেন থিয়েল।

প্রচলিত রাষ্ট্রের ধারণা এবং নাগরিকত্বের ধারণা থেকে বেরিয়ে সাইবার মুদ্রার একটি কল্পনাশ্রয়ী বিশ্বের ধারণা নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে। বইটির নতুন ভূমিকায় থিয়েল আরও দুটি বিষয় যোগ করেছেন, যা লেখকেরা বইতে যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর একটি হলো চীনের উত্থান এবং অপরটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি।

১৯৯০-এর দশকের সিলিকন ভ্যালিতে মনে করা হতো, সবচেয়ে বড় সাফল্যের পেছনে শুধু সরকারি সহায়তাই কাজ করে না, এর পেছনে ব্যক্তিপর্যায়ের সহজাত প্রতিভাও দরকার। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দে চীনের উত্থান বলছে, প্রযুক্তির আধিপত্যের জন্য আরেকটি উপাদান প্রয়োজনীয়। সেটি হলো এমন একটি রাষ্ট্র, যা তার নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করতে রাজি আছে।

থিয়েলের মতো একসময় টেসলার সিইও ইলন মাস্কও ব্যক্তির ওপর নজরদারির বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তিনিও রাষ্ট্রের হাতে থাকা সাধারণ মানুষের তথ্য নিয়ে নিজেদের ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে এসেছেন।

মাস্ক এখন তাঁর পোর্টফোলিওর অধিকতর শক্তিশালী যে দুটি উপাদানের ওপর নির্ভর করেন, তার একটি হলো স্পেসএক্স (যা ইউএস স্যাটেলাইটের প্রাথমিক উৎক্ষেপক) এবং আরেকটি হলো স্টারলিংক (যার স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে)। এই উদ্যোগগুলো এখন সরাসরি সরকারগুলোর হয়ে কাজ করছে।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিলিকন ভ্যালির প্রস্থানের কথা আমরা যেভাবে শুনে থাকি, বাস্তবে সে সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

● কুইন স্লোবোদিয়ান বোস্টন ইউনিভার্সিটির ফ্রেডরিক এস পারডি স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ