শিক্ষকসত্তা সংহারে আমরা কি গান্ধীর চেয়েও বেশি গান্ধীবাদী

এক গালে চড় মারলে আরেক গাল বাড়িয়ে দেওয়ার যে উপদেশ মহাত্মা গান্ধীর নামে প্রচলিত আছে, কয়েক দিন ধরে সে কথা বারবার মনে পড়ছে। বোঝার চেষ্টা করছি, দ্বিতীয় গালটি বাড়িয়ে দেওয়ার পর যদি সেখানেও কেউ আবার চড়াও হয়, তাহলে কী করা উচিত! তাহলে কি আবার প্রথম গালটি বাড়িয়ে দিতে হবে? সেটা বাড়িয়ে দিলে যদি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়? সে ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কি চলতেই থাকবে? গান্ধীজি হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে এক গালে চড় খেয়ে আরেক গাল পেতে দিলে চড় প্রদানকারী ব্যক্তির বোধোদয় বা অনুশোচনা হবে, তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারবেন এবং সহিংস পথ পরিত্যাগ করবেন। কিন্তু চড় প্রদানকারীর চরিত্রে যদি এ পরিবর্তন না ঘটে?

যখন আমার সামনে আমার শিক্ষককে হেনস্তা করলে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, আমার সামনে আমার সহকর্মীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠালে আমি নির্বিকার থাকি, আমার সামনে আমার সন্তানের শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরালে আমি উল্লসিত হই, এমনকি যখন আমার সামনে আমার শিক্ষক বা আমার সন্তানের শিক্ষক বা আমার সহকর্মীকে হত্যা করলেও আমি উদাসীন থাকতে পারি, তখন মনে হয় গান্ধীর চেয়ে বেশি গান্ধীবাদী হতে পেরে আমি খুশি।

চড় প্রদানকারী নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ কোথাও এমন বারবার গাল বাড়িয়ে দেওয়ার চর্চা করলে তাঁকে গান্ধীর চেয়েও বেশি গান্ধীবাদী বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। আমরা, সাধারণ মানুষেরা, এখন যেভাবে শিক্ষকসত্তা হননের বিষয়টি মেনে নিতে নিতে এটাকে একটা স্বাভাবিক ঘটনার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি, তাতে আমরাও এই অভিধা পাওয়ার দাবি করতে পারি। অনেকেই বলছেন, শিক্ষককে অপমান করা মানে জাতিকে অপমান করা, শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো মানে পুরো জাতির গলায় জুতার মালা পরানো, শিক্ষককে হত্যা করা মানে এক অর্থে এই জাতিকে নিধন করা ইত্যাদি। তা–ই যদি হয়, শিক্ষক ও জাতি যদি কিছুটা হলেও সমার্থক হয়, তাহলে তো বলতেই হবে বারবার চড় খাওয়ার পর বারবার গাল পেতে দিয়ে আমরা এখন জাতি হিসেবে গান্ধীর চেয়েও বেশি গান্ধীবাদী হওয়ার সাধনায় ব্রতী হয়েছি। এতে অনেক গান্ধীবাদী হয়তো খুশি হতে পারেন, কিন্তু আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের খুশি হওয়া উচিত হবে কি না, সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

আরও পড়ুন

যখন আমার সামনে আমার শিক্ষককে হেনস্তা করলে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, আমার সামনে আমার সহকর্মীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠালে আমি নির্বিকার থাকি, আমার সামনে আমার সন্তানের শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরালে আমি উল্লসিত হই, এমনকি যখন আমার সামনে আমার শিক্ষক বা আমার সন্তানের শিক্ষক বা আমার সহকর্মীকে হত্যা করলেও আমি উদাসীন থাকতে পারি, তখন মনে হয় গান্ধীর চেয়ে বেশি গান্ধীবাদী হতে পেরে আমি খুশি। অন্যদিকে, যাঁরা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষক হয়ে মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এই পেশায় ঢুকেছিলেন, তাঁদের যখন এসব দেখে-শুনে নীরবে–নিভৃতে ক্ষয়ে যেতে যেতে নিঃশেষ হতে দেখি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এই শিক্ষকসত্তা হননের অভিঘাত কল্পনা করি, তখন হতাশার সর্বগ্রাসী কুয়াশায় ২০৩০ বা ২০৪১–এর বড় বড় স্বপ্নসৌধ ঢাকা পড়ে যায়।

গান্ধীর চেয়েও বেশি গান্ধীবাদী হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে গিয়ে ইংরেজিভাষীরা ‘মোর লয়াল দ্যান দ্য কিং’ বা ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ’ প্রবাদ বাক্যগুলো ব্যবহার করেন। বাংলায় এমন কোনো প্রবাদ বাক্য আছে কি না জানি না, তবে একবার এক ভদ্রলোক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও বড় রবীন্দ্রনাথ হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে যে কীভাবে বিপাকে ফেলেছিলেন, সে গল্প বহুদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে গল্পটা এ রকম।

কবিগুরু একবার সদলবল সমুদ্রপথে বিলেত যাচ্ছেন। তাঁকে যাত্রী হিসেবে পেয়ে সাদা চামড়া ক্যাপ্টেন খুবই বিগলিত, অত্যন্ত সম্মানিতবোধ করলেন। প্রথম সন্ধ্যাতেই গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর কেবিনে ছুটলেন, সঙ্গে উপহার হিসেবে অত্যন্ত দামি এক বোতল পানীয়। সৌজন্য রক্ষার স্বার্থে ওই বোতলটা গ্রহণ করলেও সাক্ষাৎ শেষে কবি তাঁর এক শিষ্যকে ডেকে বললেন, যাও, ওটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসো। ডেকের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে শিষ্য যখন গুরুর আদেশ পালনে উদ্যত, তখনই তাতে বাদ সাধল মাথার ওপরের অনন্ত নক্ষত্র বীথি, একই সঙ্গে আকাশ ও সমুদ্রে ভাসমান গোলাকার অপার্থিব চাঁদ এবং তার সঙ্গে কিছু হালকা ঝোড়ো হাওয়া। গুরুর আদেশ শিরোধার্য হলেও তা আর পালন করা গেল না। এর ফল প্রতিধ্বনিত হলো মধ্যরাতে, যখন কবিগুরু তাঁর দরজার অধৈর্য কড়া নাড়ায় জেগে উঠলেন। সেই শিষ্য। অনুমতির অপেক্ষা না করে গুরুদেবকে প্রায় ঠেলে ঘরে ঢুকে গেল, হাতে ‘সোনার তরী’। ‘এটা তো লিখেছেন বেশ, বুঝেছেন কিছু?’ তারপর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও বেশি রবীন্দ্রনাথ হয়ে, রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা খোদ রবীন্দ্রনাথকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন বাকি রাত ধরে।

আরও পড়ুন

কেউ যেন আবার মনে না করেন গান্ধীর চেয়ে বড় গান্ধীবাদী হতে হলে ওই শিষ্যের মতো কোনো না কোনোভাবে নেশাগ্রস্ত হতে হবে। তা নয়, আমি শুধু বলতে চাইলাম এখানে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি রবীন্দ্রনাথ হওয়াটা হয়তো কেবলই হাস্যরসের সঞ্চার করে, কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে গান্ধীর চেয়ে বেশি গান্ধীবাদী হওয়াটা ভয়ংকর বিপজ্জনক হতে পারে।

যা–ই হোক, শিক্ষকসত্তা সংহারে আমাদের প্রতিক্রিয়া গান্ধীর চেয়েও বেশি গান্ধীবাদী হওয়া উচিত কি না, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই বিজ্ঞজনেরা পরামর্শ দেবেন। তবে আমার মনে হয়, এ দেশের প্রত্যেক সংবেদনশীল মানুষ এখন উপলব্ধি করছেন যে গাল বাড়িয়ে হোক কিংবা অন্য কোনোভাবে, যেভাবেই হোক, শিক্ষক নির্যাতনের এই মহোৎসবকে এখনই বন্ধ করতে হবে।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক