জুলাই সনদে সই না করে এনসিপির ‘একলা চলা’র ঝুঁকি ও সম্ভাবনা

ছবি: এনসিপির ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

এনসিপি কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি, এ প্রশ্নে দলের নেতারা বিপ্লবী ভঙ্গিতে অবস্থান ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আর সমালোচকেরা আশঙ্কা করছেন এতে এনসিপির ভবিষ্যৎ সংকটমুখী হতে পারে। একই সময়ে জামায়াত তাদের কৌশল নিয়ে সন্তুষ্ট; মঞ্চে ওঠার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সাসপেনস ধরে রেখেছিল। বিএনপি আপাতত স্বস্তিতে আছে। কারণ, প্রধান দলগুলোর মধ্যে অন্তত একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তবু এনসিপির অবস্থান স্পষ্টভাবে বোঝা জরুরি।
এখন পর্যন্ত এনসিপির যে নেতার বক্তব্য আমার কাছে সবচেয়ে পরিণত ও যৌক্তিক লেগেছে, তিনি খালেদ সাইফুল্লাহ। খালেদ লিখেছেন, এনসিপি জুলাই সনদ প্রণয়নের উদ্যোগকে সম্মান জানালেও আজকের অনুষ্ঠানটিকে তারা ঐকমত্যের ঘোষণা হিসেবে দেখছে না। অতীতের ‘স্বাক্ষর, কিন্তু বাস্তবায়ন নয়’ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন, সইয়ের আগে একটি স্পষ্ট ও প্রকাশ্য বাস্তবায়ন-রূপরেখা দরকার। আরও কিছু মৌলিক বিষয়ে মতভেদ রয়েছে এনসিপির। যেমন উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং অ্যান্টি–করাপশন কমিশন (এসিসি) ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) স্বাধীনতা, যা ভবিষ্যৎ জবাবদিহির কেন্দ্রে অবস্থান করে।

এনসিপির মতে, জুলাই আন্দোলনের মর্ম ছিল অনুষ্ঠান নয়, বাস্তব পরিবর্তন। তাই স্পষ্টতা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষাই সেই মর্মকে রক্ষা করে। বাস্তবায়নকাঠামো চূড়ান্ত হয়ে মৌলিক সংস্কার সুরক্ষিত হলেই তারা সই করবে বলে খালেদ লিখেছেন। তিনি লেখেন, কে আগে সই করল তা নয়, সনদটি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা কতটা ধারণ করে, সেটিই মুখ্য। একই সঙ্গে যারা শুভ বিশ্বাসে সই করেছে, তাদের সিদ্ধান্তকে তিনি সম্মান করে প্রসেসকেন্দ্রিক রাজনীতির কথা বলেছেন।

‘স্বাক্ষর, কিন্তু বাস্তবায়ন নয়’ অভিজ্ঞতার বিষয়ের একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা আছে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে এককালের সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘দালিলিক ভিত্তি হিসেবে’ আন্দোলনরত তিন জোট একটি রূপরেখা ঘোষণা করে। এটি ছিল ‘ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনীতি ও  রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল’।

যে তিনটি জোট ওই রূপরেখা প্রণয়ন ও ঘোষণা করেছিল, সেগুলো হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট এবং বাম ঘরানার দলগুলোর সমন্বয়ে পাঁচদলীয় জোট। এর বাইরে একই দাবিতে জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, তবে তারা কোনো জোটে ছিল না। যা–ই হোক, এনসিপির সংশ্লিষ্ট একাধিক বুদ্ধিজীবী গত এক বছরে অনেকবারই এই রূপরেখার উদাহরণ টেনেছেন ও বলেছেন, এই রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে জুলাই সনদও বাস্তবায়িত হবে না।

আরও পড়ুন

আমি এ ঘটনার ব্যাখ্যার সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। ‘একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ গঠনের লক্ষ্যে এরশাদের পতন’ ছিল এই রূপরেখার কেন্দ্রীয় দাবি। এই দাবি আংশিকভাবে পূরণ হয়েছিল। আমরা দেখেছি ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হয়।

রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করে; কিন্তু পরে দুই প্রধান দলই অর্থাৎ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিজেদের রূপরেখাকে শুধু উপেক্ষাই করেনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো কাজ করেছে। গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। এত বড় ব্যাখ্যা দেওয়ার কারণ হলো এনসিপির এই আশঙ্কার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। তবে এনসিপির এই ব্যর্থতার অভিযোগ আংশিকভাবে সত্য, পুরোপুরি নয়।

আমার মনে হয়েছে, এনসিপি নেতা খালেদ সেখান থেকেই বলেছেন ‘স্বাক্ষর, কিন্তু বাস্তবায়ন নয়’ অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়েছে। খালেদের এই মতামত আমি যৌক্তিক বলব, একেবারে অস্বীকার করছি না। বিশেষ করে যখন তিনি লেখেন, ‘আওয়ার ডিফারেন্সেস লাই ইন অ্যাপ্রোচ, নট ইন পারপাস’, তখন তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়।

রাজনৈতিক কারণে আমি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পক্ষে, তা যেমন দুর্বলই হোক না কেন। আমি নিশ্চিত নই, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র উত্তরণে কতটা বড় ভূমিকা রাখবে। তবু নির্বাচনের আগমুহূর্তে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছিল এই সনদ। সনদে স্বাক্ষর হওয়ায় আপাতত নির্বাচনের পথে বড় বাধা থাকল না। বাস্তব কথা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে স্থিতির দিকে যেতে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প নেই। অবশ্য নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র আসবে, এটা নয়; কিন্তু শুরুটা জরুরি।

এই মতামতের পাশাপাশি আরেকটি মতামতও দেখলাম। এই মতামতটি আপাতদৃষ্টে শক্তিশালী মনে হয়েছে ও একাধিক এনসিপি নেতা পোস্ট করেছেন। এর বয়ানের মূল বক্তব্য হলো জুলাই সনদ দেখে তাদের মনে হয়েছে, সেখানে তাদের প্রত্যাশিত নানা সুরক্ষার গ্যারান্টি নেই। তাই তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ‘মরবে এনসিপি, বিএনপিরও কিছু হবে না, জামায়াতেরও কিছু হবে না।’ গত এক বছরে অনেকে এ ধরনের কথা বহুবার বলেছেন।

এনসিপির এই ধারাবাহিক ‘নিজেকে ভিকটিম’ দেখানোর প্রবণতার সঙ্গে আমি একমত নই। প্রথমত, ভিকটিমহুড-নির্ভর রাজনীতির সমালোচক আমি; এই রাজনীতি আমাদের ভালো কিছু দেয়নি। আওয়ামী লীগের উদাহরণই যথেষ্ট, যারা ভিকটিম ন্যারেটিভ দেখিয়ে রাজনীতি করেছেন, অনেক সময় নিজেরাই ‘জালিম’ হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের ভিকটিম ন্যারেটিভ দিয়ে তা বৈধতা দেন।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এ স্বাক্ষরের পর সনদের কপি তুলে ধরেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। যদিও এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দল এ সনদে স্বাক্ষর করেনি। দলগুলোর নেতারাও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেননি। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়
ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

তাই এনসিপির ‘নিজেকে ভিকটিম’ দেখানোর বয়ানের তুলনায় এনসিপি নেতা খালেদের ব্যাখ্যা, ‘আওয়ার ডিফারেন্সেস লাই ইন অ্যাপ্রোচ, নট ইন পারপাস’, এটি আমার কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী মনে হয়েছে। এটি একটি নৈতিক অবস্থান; ব্যক্তিগতভাবে আমি এনসিপির এই নৈতিক অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে ভিকটিমহুডের বয়ানের বিরোধী।

বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের মতো ‘মাৎস্যন্যায়ের’ দেশে সনদ, সংবিধান, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাস্তব রাজনীতির মাঠে এর প্রভাব তেমন থাকে না। তাই শুধু আইনের দোহাই দিয়ে এনসিপি নেতাদের ভবিষ্যৎ ভিকটিম হওয়ার ভয় কাটানো সম্ভব নয়।

ভিকটিম হয়ে থাকার গল্প রাজনীতিতে সহানুভূতি তো আনে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা গণতন্ত্র তৈরির পথ দেখায় না। তাই ‘আমরা মরব, বাকিরা বাঁচবে’, এমন ভাষা আমাদের ক্লান্ত করে, বিভেদ তৈরি করে। খালেদ সাইফুল্লাহর লেখা, ‘আওর ডিফারেন্সেস লাই ইন অ্যাপ্রোচ, নট ইন পারপাস’ বরং আমাদের যুক্তি দিয়ে বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করে। লক্ষ্য একই, পথ ভিন্ন, এই বার্তা ঐক্য ভাঙে না, আবার শর্তও তুলে ধরে। এনসিপি নেতা খালেদ যে ‘প্রতিষ্ঠান’ ও ‘প্রসেস’ গড়ার কথা বলছে, সেটিই আসল রাজনীতি। এখন দেখার বিষয়, তারা এই ‘প্রসেসের রাজনীতি’র পথে সত্যিই এগোয় কি না।

আরও পড়ুন

উপমহাদেশ ও এর বাইরে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দেখায়, কাগজের প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়, পাকিস্তানের ২০০৬ সালের চার্টার অব ডেমোক্রেসির কথা বলা যায়, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো বহু বিষয়ে ঐকমত্য এলেও যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা ক্ষমতায় গিয়েই অগ্রাধিকার বদলে দিয়েছে, সংস্কারের বড় অংশ বাস্তবায়ন করেনি।

আবার তিউনিসিয়ায় (২০১১-১৪) আধুনিক সংবিধান তৈরি করে তারা কিন্তু দলগত টানাপোড়েনের কারণে তাদের গণতন্ত্রের যাত্রা ধীরগতিতে এগোয়। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে—নথি নয়, প্রতিষ্ঠান কতটা শক্ত, সেটিই মুখ্য। আবার শ্রীলঙ্কার (২০২২) কথা বলা যায়, যেখানে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তবে সংস্কার বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান অপরিবর্তিত থাকায় নীতি-সংস্কার বারবার আটকে গেছে। এসব উদাহরণ মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, সনদ স্বাক্ষর গুরুত্বপূর্ণ; তবে বাস্তবায়ন বেশ দুরূহ।

আরও পড়ুন

রাজনৈতিক কারণে আমি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পক্ষে, তা যেমন দুর্বলই হোক না কেন। আমি নিশ্চিত নই, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র উত্তরণে কতটা বড় ভূমিকা রাখবে। তবু নির্বাচনের আগমুহূর্তে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছিল এই সনদ। সনদে স্বাক্ষর হওয়ায় আপাতত নির্বাচনের পথে বড় বাধা থাকল না। বাস্তব কথা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে স্থিতির দিকে যেতে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিকল্প নেই। অবশ্য নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র আসবে, এটা নয়; কিন্তু শুরুটা জরুরি।

একই সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ১০০ শতাংশ প্রতিশ্রুতি দেখাবে, এমন আশা করি না; তাই এই জায়গায় এনসিপির আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে আমি সাফল্য দেখছি ওখানে যে আপাতত জুলাই নিয়ে ঘোষণা ও সনদের রাজনীতির একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য অবস্থায় পৌঁছানো গেছে, সিভিল নর্মে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সদিচ্ছা দেখিয়েছে। নির্বাচনের আগে তাই এই ইস্যুতে জল ঘোলা করার খুব একটা সুযোগ থাকল না।

দেখার বিষয়, নির্বাচনের দিকে এখন রাজনীতি কেমন করে এগিয়ে যায়। আমাদের রাষ্ট্র ভাঙনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচন না হলে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন না হলে রাষ্ট্রের এই ভাঙন থেকে রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পড়বে। তাই আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থেই মধ্যপন্থা জরুরি, রাজনীতিতে সিভিল নর্ম পালন করা জরুরি।

  • আসিফ বিন আলী বর্তমানে কাজ করছেন আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তিনি পেশায় শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীন সাংবাদিক।

*মতামত লেখকের নিজস্ব