বিভাজনের কৌশলই কাল হলো বিজেপির

নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথ ও অমিত শাহ

গত ১০ বছরে নরেন্দ্র দামোদর মোদির একচ্ছত্র শাসন ক্রমেই স্বৈরাচারী কায়দায় শক্তিশালী শাসক হয়ে ওঠে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা নিশ্চিত ছিলেন যে তৃতীয়বারের মতো তিনি আরও শক্তিশালী অবস্থায় নির্বাচনী বৈতরণী পার করবেন।

গত ১০ বছর বিজেপি ভারতকে যেভাবে জাত-পাত, সংখ্যাগরিষ্ঠ আর সংখ্যালঘু তত্ত্বে বিভক্ত করেছে, তাতে শুধু ভারতের উদার গণতন্ত্রের চরিত্রেই নয়, উপমহাদেশের অতীব জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণেও প্রভাব ফেলেছে।

ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রায় কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। দেশ চালিয়েছিলেন অনেকটা স্বৈরশাসকের মতো। যার উদাহরণ ২০১৬ সালে হঠাৎ করে ১০০০ ও ৫০০ রুপির মহাত্মা গান্ধী সিরিজের নোট বাজার থেকে রাতারাতি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোদি একাই মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া। যার কারণে পথে বসতে হয়েছে গরিব প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও মানুষকে। কিন্তু যে কারণে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলা হয়েছে, সেই কালোটাকার দৌরাত্ম্য ভারতে কমেনি।

শুধু এই একক সিদ্ধান্তই নয়, এমনকি কোভিড-১৯–এর সময় সরকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি; বরং কোভিড-১৯–এর মতো অবস্থা কেন্দ্র করে বিজেপি তথা মোদির রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার অভিযোগ ছিল।

অপর দিকে গত ১০ বছরে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এমনভাবে ছড়ানো হয়েছিল, যার প্রভাব গোটা দুনিয়া থেকে উপলব্ধি করা যাচ্ছিল। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও। তৈরি হয়েছিল বিজেপি–আরএসএস প্রভাবিত কথিত ‘গো–রক্ষক’ কমিটি, যার টার্গেট ছিল মুসলমান সম্প্রদায় এবং গরুর মাংসের চাহিদা থাকা দলিত সম্প্রদায়ের ওপর।

এরই জের ধরে বিহার, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটসহ অনেক স্থানে প্রকাশ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু নাগরিককে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আন্তধর্মীয় বিবাহকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’।

ক্রমেই মোদি ও বিজেপি ভক্ত হিন্দু উগ্রবাদীদের ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমবিরোধী করে তোলা হয়। এমনকি এবারের নির্বাচনের আগে বলিউডকেও ব্যবহার করা হয় এই উদ্দেশ্যে।

মোদি সরকারের এই ১০ বছরে বেশির ভাগ ভারতীয় মিডিয়াকে বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বিজেপি তথা মোদি সরকারের কুক্ষিগত করার দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেক পত্রিকায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় চ্যানেল এনডিটিভি মোদির ঘনিষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠিত বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী গৌতম আদানি নানাবিধ উপায়ে কিনে নিয়েছিলেন।

স্মরণযোগ্য যে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে বিবিসির মুম্বাই ও দিল্লি অফিসে কর বিভাগের তল্লাশিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি হয়রানিমূলক ব্যবস্থা বলে উদ্ধৃত করে।

এ ঘটনা এমন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে, যার প্রায় সপ্তাহখানেক আগে বিবিসি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে সমালোচনামূলক তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছিল।

বিগত কয়েক বছর এবারের নির্বাচন সামনে রেখে যেভাবে হিন্দু-মুসলমান বিষয়টি দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে তুলে এনেছেন, তা ভারতের ইতিহাসে বিরল।

মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’, অধিক সন্তানের জন্মদাতা এবং বিজেপি না থাকলে মুসলমানেরা হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করবে—এ ধরনের প্রকাশ্য বক্তব্য ছিল ভারতকে বিভাজন করা।

অপর দিকে পাঠ্যপুস্তক বিশেষ করে ইতিহাস থেকে ৭০০ বছরের মুসলমানদের ইতিহাস বাদ দেওয়া, সবই ছিল হিন্দুত্ববাদের তত্ত্ব ছড়ানোর অংশ।

অবশেষে নির্বাচন সামনে রেখে বিতর্কিত জায়গায় ভগবান রামমন্দির স্থাপন করে নির্বাচনী ফায়দা নেওয়াই ছিল মুখ্য।

শুধু ফয়েজাবাদেই নয়, উত্তর প্রদেশ, যে রাজ্য বিজেপির শক্ত দুর্গ বলে আখ্যায়িত, সেখানকার অযোধ্যা অঞ্চলেই নয়টি আসনের পাঁচটিতে বিজেপি হেরেছে। উত্তর প্রদেশে তো বিজেপিকে এমন ধাক্কা খেতে হয়েছে, যা হয়তো নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এমনকি হিন্দুবাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ধারণাও করতে পারেননি।

ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে অযোধ্যা যেখানে মসজিদ ভেঙে রামমন্দির তৈরি করা হয়েছে, সেখানকার বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া হিন্দুগোষ্ঠী রামের নামে রাজনীতি গ্রহণ করেনি। তার উদাহরণ ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল।

‘অযোধ্যা’ যে আসনে ‘ফয়েজাবাদ’, সেখানে প্রায় ৫৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরপর দুবারের বিজেপির নির্বাচিত লোকসভার সদস্য লাল্লু সিংকে হারিয়েছেন অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে আইএনডিএ জোটের শরিক সমাজবাদী পার্টির আওয়াদেশ প্রসাদ।

শুধু ফয়েজাবাদেই নয়, উত্তর প্রদেশ, যে রাজ্য বিজেপির শক্ত দুর্গ বলে আখ্যায়িত, সেখানকার অযোধ্যা অঞ্চলেই নয়টি আসনের পাঁচটিতে বিজেপি হেরেছে।

উত্তর প্রদেশে তো বিজেপিকে এমন ধাক্কা খেতে হয়েছে, যা হয়তো নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এমনকি হিন্দুবাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ধারণাও করতে পারেননি। কারণ, উত্তর প্রদেশ শুধু ঐতিহাসিকই নয়, ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য, যেখানে ৮০টি আসন রয়েছে।

আর এই উত্তর প্রদেশেই বিরোধী আইএনডিএ জোটের সমাজবাদী পার্টির কাছে ৩৭ ও জোটের কাছে ৪৩ আসন হারিয়েছে। এর মানে যে উত্তর প্রদেশে হিন্দুত্ববাদের সূতিকাগার বলে পরিচিত হয়েছিল, সেখানেই ব্যাপক পরাজয় হয়েছে শাসক দলের।

আরও পড়ুন

অপর দিকে পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবসহ অনেক রাজ্যে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে গতবারের ১৮ আসন কমে এবার ১২–তে ঠেকেছে। এককথায় যে বিজেপি এককভাবে ৪০০ আসন অর্জনের উদ্দেশ্যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল, আক্রমণাত্মক প্রচারণা করেছিল, সেখানে তাদের ২৪০টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হয়ে এখন সরকার গঠনের জন্য জোটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বিজেপিকে।

অপর দিকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গতবারের থেকে ৪৭টি আসন বেশি পেয়ে ৯৯টি আসন এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী জোট অভূতপূর্ব ফলাফলে ২৩৪টি আসন পেয়েছে। উত্তর প্রদেশে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে সমাজবাদী পার্টি একাই বিজেপির ধস নামিয়েছে ৮০টির মধ্যে ৩৭টি আসন জিতে।

বিজেপিকে সরকার গঠনের জন্য দুটি প্রান্তিক দল নীতীশ কুমারের বিহারভিত্তিক জনতা দল ইউনাইটেড এবং অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডুর পুত্রের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে নেওয়ার দর–কষাকষি চলছে। রোববার সরকারের প্রধান হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি নয়, তিনি প্রধান হতে যাচ্ছেন মূলত এনডিএর (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স)।

নরেন্দ্র মোদি যেভাবে সাম্প্রদায়িক অঙ্গনে, সামাজিকভাবে ভারতকে বিভাজন করেছেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০১৯ সালের ২০ মে সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। সেখানে নরেন্দ্র মোদির ছবি দিয়ে শিরোনাম করা হয়েছিল ‘ইন্ডিয়াস ডিভাইডার ইন চিফ’। মানে ভারতীয় রাষ্ট্র ভাগ করার প্রধান কারিগর। এই শিরোনামই জানান দেয় যে মোদির শাসনকালে উদারপন্থী ভারতের এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্রমাগত অবনতির বিষয়।

নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির এমন স্বর্গ হতে বিদায়ের কারণ রয়েছে বহুবিধ, যা নরেন্দ্র মোদি ধর্তব্যের মধ্যে নেননি। কারণ, তিনি এক ঔদ্ধত্যের জগতে ছিলেন। নিজেকে ভগবানের অবতার রূপে হাজির করেন। এমনকি তিনি বলেন যে তিনি বায়োলজিক্যাল নয়, ভগবান কর্তৃক প্রেরিত পুরুষ, ভগবান রাম বা বিষ্ণুর অবতার। এ কারণেই তিনি ক্রমেই ভারতের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যোজন দূরে সরে গিয়েছিলেন। একদিকে ভারতকে শক্তিশালী এবং উন্নয়নে প্রথম বিশ্বের দুয়ারে নিয়ে যাওয়ার নেশায় গরিব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করার প্রতিকার তাঁর চলন–বলন ও ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়েছিল। তদুপরি ভারতের উদার সংবিধানের পরিবর্তনের আশঙ্কা, গান্ধী ও নেহরু পরিবারকে নিচু দেখানোর প্রয়াশ এমনকি মহাত্মা গান্ধীর জায়গা তাঁর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ও হিন্দুত্ববাদের জনক বলে পরিচিত বীর সাভারকারকে নায়কের আসনে বসানোর প্রয়াস বেশির ভাগ ভারতীয়রা ভালোভাবে নেননি।

বিশ্লেষকদের মতে, এসব ও অন্যান্য কারণে ভোটাররা মোদির পালক কেটে পৃথিবীতে নামিয়েছে।

এবার তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী মোদি হবেন, কিন্তু তাঁর নিয়ামক আর তিনি থাকছেন না। কিংমেকার হয়ে থাকবেন একদিকে নীতীশ কুমার ও অন্যদিকে চন্দ্রবাবু নাইডু, দুজনেই অতীতে বিজেপির বিরুদ্ধে ছিলেন।

তবে এই ফলাফল ভারতের উদার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হবে। হয়তো ‘মূক–বধির’গণ বাক্‌শক্তি ফিরে পাবে। সংসদে বহু বছর পর বিশাল বিরোধী দল হাজির থাকবে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

ভারতীয় নির্বাচন ২০২৪ থেকে প্রধানত যা নেওয়ার, তা হলো ‘জনগণই ক্ষমতার উত্স’ যদি জনগণকে সে ক্ষমতা প্রয়োগের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়, যা ভারতের নির্বাচনগুলোতে দৃশ্যমান। যদিও এবার বহু অভিযোগ রয়েছে। তবু ভারতের এই নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও বিজয় বলতেই হবে।

 ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) 

[email protected]