মধ্যপ্রাচ্যে ‘টাইমবোমা’ বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে

ইসরায়েল ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে পশ্চিম তীরে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া যায়, সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেছবি : রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও এর আরব মিত্ররা মনে করছেন, পবিত্র রমজান মাসে (শুরু হতে এক মাসও বাকি নেই) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর পাঁচ মাস বয়সী গাজা যুদ্ধ সমাপ্ত ঘোষণা করবেন। বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ্যে এটি না বললেও রুদ্ধদ্বার আলাপে ইসরায়েলকে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।

এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গাজা নিয়ে কী করবেন তা নিয়ে দিনের পর দিন ধরে পরিকল্পনা করছেন। এর মধ্যে শুধু বিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার কথা আলোচনা হয়নি, দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রশ্নটিকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সুস্পষ্ট একটি পথের কথা তাঁরা ভাবছেন, যার বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে।

এখন ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন–গ্যভির পশ্চিম তীরের প্রায় সব ফিলিস্তিনিকে পবিত্র রমজান মাসে পূর্ব জেরুজালেম ও আল আকসায় প্রবেশে বাধা দিতে চাইছেন। এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ পশ্চিম তীরের ক্ষোভের দাবানল জ্বালিয়ে দিতে পারে। আর সেটা শুধু পশ্চিম তীরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে পুরো অঞ্চলে।
আরও পড়ুন

এই পদক্ষেপের ক্ষেত্রে একটি মূল বাধা হলো, নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থী জোট। এটা এখন প্রতীয়মান যে নেতানিয়াহু গং একটি প্যারালাল বা সমান্তরাল বিশ্বে বসবাস করছেন। তাদের সেই বিশ্বটা বাকি বিশ্ব কী নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।

গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যে ঘটনাপ্রবাহ, তাতে খুব কম ক্ষেত্রেই বাইডেন প্রশাসন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। আধুনিককালে বেসামরিক জনসাধারণের ওপর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তাতে বাইডেন প্রশাসন খুব জোরালোভাবে তেল আবিবের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহু সব সময় পরিষ্কার করে বলছেন যে গাজা নিয়ে তার অ্যাজেন্ডা বাইডেন প্রশাসন ও তাদের আরব মিত্ররা কী ভাবছে তা থেকে ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরব মিত্ররা যখন কীভাবে গাজা যুদ্ধের অবসান হবে তা নিয়ে ভাবছে, তখন ইসরায়েল ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে পশ্চিম তীরে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া যায়, সেই প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে যে নৃশংস ও নির্বিচার সামরিক অভিযান ইসরায়েল জারি রেখেছে, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে নেতানিয়াহুর লক্ষ্য শুধু হামাস নয়। তার লক্ষ্য হলো ২২ লাখ ফিলিস্তিনের (যাদের ৭০ শতাংশ উদ্বাস্তু) বসতি গাজাকে পুরোপুরি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া এবং গাজাকে বিরান ভূমিতে পরিণত করা।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সূচনা করে আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুযোগ ইসরায়েলের সামনে রয়েছে। যাহোক নেতানিয়াহু এবং তার মিত্ররা বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যদি একতরফা সিদ্ধান্ত আসে, তারা সেটা মেনে নেবে না। গত সোমবার ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ এই বলে হুমকি দেন যে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে অসলো চুক্তি বাতিল করা হবে এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বিলুপ্ত করা হবে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স পশ্চিমা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে বলছে যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়টি তাদের টেবিলে রয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্যারিসের জন্য কোনো ‘ট্যাবু’ নয়। মাখোঁর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহুর কার্যালয় বিবৃতিতে বলেছে, ‘এখন ফিলিস্তিনি জনগণকে কোনো উপহার দেওয়ার বিষয়ে কথা বলার সময় নয়।’

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর মন্ত্রীরা যখন খোলাখুলিভাবে বললেন যে ১৮ লাখ ফিলিস্তিন উদ্বাস্তুর বসতি রাফায় কোনো স্থল অভিযান তারা সমর্থন দেবে না, তখন নেতানিয়াহু এর প্রতিবাদ করলেন।

আরও খারাপ বিষয় হলো, বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে হামাসের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। এ ধরনের চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, মিসরও কাতারের সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও যুক্ত ছিল।

আবার ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে প্রাথমিক রায়ের পর বাইডেন প্রশাসন যখন ইসরায়েলকে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত বন্ধে সামরিক অভিযানে রাশ টেনে ধরতে বলছে, তখন নেতানিয়াহু সরকার সব আবেদন–নিবেদন প্রত্যাখ্যান করছে। নেতানিয়াহু তাঁর সেনাবাহিনীকে খান ইউনুসে হামলা চালানোর আদেশ দিচ্ছেন।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সেখানে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, সংবাদ মাধ্যমের কার্যালয়, মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে গাজা, রাফা ও ফুঁসতে থাকা পশ্চিম তীরে পবিত্র রমজান মাস কীভাবে আসতে চলেছে। পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের লাগাম টেনে ধরতে ও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ উপেক্ষা করে ইসরায়েল সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী প্রতিদিন শহরগুলোতে ও শরণার্থীশিবিরে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, তার ফলাফল হচ্ছে মারাত্মক।

এখন ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন–গ্যভির পশ্চিম তীরের প্রায় সব ফিলিস্তিনিকে পবিত্র রমজান মাসে পূর্ব জেরুজালেম ও আল আকসায় প্রবেশে বাধা দিতে চাইছেন। এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ পশ্চিম তীরের ক্ষোভের দাবানল জ্বালিয়ে দিতে পারে। আর সেটা শুধু পশ্চিম তীরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে পুরো অঞ্চলে। পবিত্র রমজান মাসেও গাজায় যদি গণহত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকে, রাফায় যদি সামরিক আগ্রাসন শুরু হয় এবং লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে যদি আল–আকসায় নামাজ পড়তে না দেওয়া হয়, তাহলে দাবানল ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য।

  • ওসামা আল–শরিফ জর্ডানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত