সম্প্রতি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার বর্তমান দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ১০ এপ্রিলের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা থেকে সারের মূল্যবৃদ্ধির এ আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের মূল্য পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দাবি করেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০টাকা। ফলে ৫ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির যে দাবি কৃষি মন্ত্রণালয় করেছে, তার সত্যতা যাচাই করে দেখা যাক।
এর আগে আন্তর্জাতিক দামের কথা বলে ২০২২ সালের আগস্টে ইউরিয়ারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। সে সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ৮১ টাকা। ফলে ৬ টাকা দাম বাড়ার পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। সে সময় কৃষিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও কমানো হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আগস্ট ২০২২–এর সঙ্গে ১১ এপ্রিল ২০২৩–এর বিবৃতির তুলনা করলে দেখা যায়, আগস্ট ২০২২–এ ইউরিয়া সারের দাম ছিল প্রতি কেজি ৮১ টাকা আর বর্তমানে দাম ৪৮ টাকা এবং প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা আগস্ট ২০২২–এ ছিল ৫৯ টাকা আর বর্তমানে তা ২১ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ার কারণে সরকার দেশে সারের দাম বাড়ানোর যে যুক্তি দিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ধারণা করা যেতে পারে, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভর্তুকি কমানোর যে শর্ত আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে পূর্ণ করতে হবে, তার অংশ হিসেবেই সারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের কৃষকেরা তুলনামূলক অসংগঠিত, সে কারণেই কৃষকদের ঘাড়ে সারের মূল্যবৃদ্ধির এই বোঝা চাপানো হলো।
কাজেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, আগস্ট ২০২২–এর তুলনায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়া সারের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ৩৩ টাকা এবং ইউরিয়া সার বাবদ সরকারের ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা কমেছে কেজিপ্রতি ৩৮ টাকা! কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির তথ্যটি সঠিক নয় এবং সেই হিসেবে দেশের বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তি নেই। বরং আগস্ট ২০২২–এ দেওয়া কৃষিমন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমার কারণে দেশে সারের দাম কমানো উচিত।
শুধু ইউরিয়া সারই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে বাংলাদেশে যেসব সারের দাম বাড়ানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তার সব কটির দামই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ৪ এপ্রিল ২০২৩–এ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের কমোডিটি প্রাইস ডেটা (দ্য পিংক শিট) অনুসারে, ২০২২–এর জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি (পটাশিয়াম ক্লোরাইড)—এই চারটি সারের প্রতি টনের দাম ছিল যথাক্রমে ৮২১, ৭১৫.৬, ৭৯৪.৯, ও ৮৫১.৭ ডলার, যা ২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে কমে হয়েছে যথাক্রমে ৩৭১.৬, ৫৫১.৫, ৬১৬.৫ ও ৪৮৬.২ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের দাম কমেছে যথাক্রমে ৫৪.৭৪ শতাংশ, ২২.৯৩ শতাংশ, ২২.৪৪ শতাংশ ও ৪২.৯১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের এই ব্যাপক দরপতনের কারণে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩–এ ভর্তুকি কম লাগবে, বেশি নয়।
কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়ার কারণে সরকার দেশে সারের দাম বাড়ানোর যে যুক্তি দিয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ধারণা করা যেতে পারে, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভর্তুকি কমানোর যে শর্ত আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে পূর্ণ করতে হবে, তার অংশ হিসেবেই সারের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের কৃষকেরা তুলনামূলক অসংগঠিত, সে কারণেই কৃষকদের ঘাড়ে সারের মূল্যবৃদ্ধির এই বোঝা চাপানো হলো।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন, যার মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের পরিমাণ মোট ৫৯.৫ লাখ টন। এসব সারের মূল্য কেজিপ্রতি ৫ টাকা, অর্থাৎ টনপ্রতি ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধির কারণে কৃষকদের কাছ থেকে এক বছরে বাড়তি আদায় করা হবে ২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। সারের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ কৃষকের ঘাড়ে দেওয়া হলো এমন এক সময়ে, যখন ডিজেল, বিদ্যুৎ, বীজসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণের বাড়তি মূল্যের কারণে কৃষক এমনিতেই বিপর্যস্ত।
সারের মূল্যবৃদ্ধির চাপ শুধু কৃষকের ওপরই নয়, উৎপাদিত ফসলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের সব মানুষের ওপরেই পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য হ্রাস পেলেও সরকার দেশের বাজারে জ্বালানির দাম কমাচ্ছে না। এর সঙ্গে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কারসাজি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অক্ষমতার কারণে এমনিতেই দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত সিপিডির এক প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সব ধরনের চালের দাম একই মানের—থাই ও ভিয়েতনামের চালের দামের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি।
নভেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও একই সময়ে স্থানীয় বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেনি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিনির দাম বাংলাদেশে প্রতি কেজি ছিল ১২২ টাকা, কিন্তু মার্কিন বাজারে প্রতি কেজি মাত্র ৮০ টাকা, বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা এবং ইইউর বাজারে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। পরিবহন খরচ, আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য বাণিজ্য-সম্পর্কিত খরচের বিষয়গুলো বিবেচনা করলেও দামের এই ব্যাপক পার্থক্য অস্বাভাবিক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সারের এই মূল্যবৃদ্ধি দেশের খাদ্যপণ্যের সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে আরও অসহনীয় করে তুলবে।
সরকার যতই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করুক, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশকে বছরে এক কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। কাজেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সরকার একদিকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছে, অন্যদিকে সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উপকরণের মূল্য বাড়াচ্ছে। মূল্য না বাড়িয়েই সার বাবদ ভর্তুকি কমাতে হলে রাসায়নিক সারে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। এ জন্য দেশের সারখানার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভর্তুকি হৃাসের বোঝা কৃষকের ঘাড়ে চাপানো যাবে না।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]