জাপান যে কারণে কূটনৈতিক অবস্থান বদলে ফেলছে

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা সম্প্রতি ইউক্রেন সফর করেন। ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে নিরাপত্তা তথ্য বিনিময়ের উপর জোর দিলেও তিনি আবারও ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান।ছবি : রয়টার্স

এপ্রিলের মাঝামাঝি জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিপ্লোমেটিক ব্লুবুক–২০২৩ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কে এটি জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াশি ইয়োশিমাসা এখানে যে ভূমিকা লিখেছেন, তার শুরু হয়েছে এভাবে, ‘বিশ্ব এখন ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।’
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ক্ষেত্রে এই শব্দগুচ্ছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইউক্রেনে রুশ বাহিনী প্রবেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাপানের সরকার গ্রুপ–৭–এর বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে, ‘বড় মাত্রার সামরিক আগ্রাসন’–এর জন্য রাশিয়াকে নিন্দা জানানো হয়েছিল এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘গুরুতর ও সমন্বিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ আরোপের আহ্বান জানানো হয়েছিল।

এর পরের দিনই জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াশি ‘রাশিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের’ ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলনে। রাশিয়ার তিনটি ব্যাংকের সম্পদ স্থগিত এবং রাশিয়ার সামরিক রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিলেন।

এর আগে ২০২২ সালের ডিপ্লোমেটিক ব্লুবুকে জাপান রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়েছিল এবং রুশ সরকারের প্রতি, ‘ইউক্রেন থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহার এবং আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার’ আহ্বান জানিয়েছিল। জাপানের যুক্তিতে রাশিয়ার এই যুদ্ধ ‘বিশ্বব্যবস্থার মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে’। ২০২৩ সারের ব্লুবুকে জাপান যুক্তি দিয়েছে, ‘এই যুদ্ধ বিশ্বকে একটা সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে।’

জাতীয় স্বার্থ

নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে এসব কথাবার্তা সত্ত্বেও জাপান রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে জাপানের মোট আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সাড়ে ৯ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এই জ্বালানির বেশির ভাগটা এসেছে রাশিয়ার সাখালিন দ্বীপ থেকে, সেখানে জাপান সরকার ও দেশটির কোম্পানিগুলোর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।

গত বছরের জুলাই মাসে হায়াশিকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, জাপান কি সাখালিন–২ প্রকল্প থেকে আমদানি অব্যাহত রাখবে কি না? এই প্রশ্নে তাঁর উত্তর ছিল স্পষ্ট: সাখালিন–২ প্রকল্পটি জাপানের জ্বালানিনিরাপত্তা এবং জাপানের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে বিবৃতি দেওয়া সত্ত্বেও জাপান নিজেদের জাতীয় স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জাপানের সরকার দেশটির দুটি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি মিৎসু ও মিৎসুবিশিকে রাশিয়ার সাখালিন–২ প্রকল্পে সংযুক্ততা বাড়ানোর জন্য বলে।

ব্লুবুক ২০২৩–এ জাপান এ বিষয়টি স্বীকৃতি দিয়েছে যে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলো ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের অবস্থান অনুসরণ করছে না। দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলো পশ্চিমের ‘দ্বিমুখী’ (পশ্চিমাদের শুরু করা যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য, আর অন্যদের শুরু করা যুদ্ধ অগ্রহণযোগ্য) অবস্থানকে দায়ী করা বাড়ছে। নতুন ব্লুবুকে উল্লেখ করা হয়েছে, জাপান বহুপক্ষীয়বাদকে উৎসাহিত করবে এবং ‘পার্থক্যগুলো ঘোচাবে এমন একটি সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করবে’। এ জন্য নতুন মনোভাব প্রয়োজন।

২০২২ সালের মার্চ মাসে কিয়েদো নিউজ ডিপ্লোমেটিক ব্লুবুকের একটি ফাঁস হওয়া সংস্করণ প্রকাশ করে। সেখানে আরও চমকপ্রদ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছিল। হোকাইদিও দ্বীপে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণকে সেখানে‘অবৈধ দখলদারত্ব’ বলে বর্ণনা করা হয়। ২০০৩ সালের পর জাপান সরকার আর এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেনি। এর বড় কারণ হলো, সাখালিন–২ দ্বীপের যৌথ উন্নয়নের স্বার্থে জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত হয়েছে।

ডিপ্লোমেটিক ব্লুবুক ২০২২ প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গিয়েছিল, কিয়েদো নিউজে ফাঁস হওয়া খসড়াটির মতো মূল নথিতে অবৈধ দখলদারত্ব শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়নি। এর পরিবর্তে ব্লুবুকে বলা হয়েছে, ‘উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত ইস্যু জাপান ও রাশিয়ার মধ্যকার সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়’, এটা ‘এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি’।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্র করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের বৈরিতাকে জাপান দেশটির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ দ্বীপগুলোর ওপর নিজেদের দাবি জানানোর একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারত। কিন্তু এর পরিবর্তে জাপান সরকার কেবল এই আশা প্রকাশ করেছে যে রাশিয়া ইউক্রেন থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবে এবং জাপানের উত্তর সীমানার দ্বীপগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ‘আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তি চুক্তিতে’ পৌঁছাবে।

তিনটি নতুন বিষয়

ডিপ্লোমেটিক ব্লুবুক ২০২৩–এ তিনটি নতুন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এক. ঠান্ডা যুদ্ধ–পরবর্তী যুগের অবসান হয়েছে, দুই. চীন জাপানের সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও তিন. দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলোকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এ বছরের ব্লুবুক জাপানের দ্বিধার বিষয়টি স্পষ্ট করছে। এটাকে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা এবং দক্ষিণ বিশ্বের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি—এই দুইয়ের মধ্যে ধরা যায়।

২০২২ সালের ব্লুবুকে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন যুগ পরিবর্তনের সূচনাকারী একটা সময় পার করছে।’ যাহোক, ব্লুবুক ২০২৩–এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ঠান্ডা যুদ্ধ–পরবর্তী যুগের অবসান’ হয়েছে। এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার (যেটাকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান নিয়মবিধি–ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বলে মনে করে) অবসান ঘটা। ওয়াশিংটনের প্রতিপত্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু এরপর কী আসছে, সেটা স্পষ্ট নয়।

আরও পড়ুন

চীনকে কেন্দ্র করে জাপানের উদ্বেগ নতুন নয়। সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘকালের। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আরও সুস্পষ্ট ও বিপজ্জনক।
জাপান তাদের ব্লুবুক ২০২৩–এ চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এ সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারত্ব বলে মনে করেনি তারা। এমনকি সেখানে জাপান সরকার স্বীকার করেছে যে দুই দেশের মধ্যকার (জাপান ও চীন) যৌথ বিষয়ে আলোচনার জন্য একগুচ্ছ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে একটি গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক স্থাপনে জাপান ও চীনের যৌথ প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিশেষে, জাপান সরকার এটা গ্রহণ করে নিয়েছে যে দক্ষিণ বিশ্বে নতুন এক মনোভাব তৈরি হয়েছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর ইচ্ছার কাছে আর নিজেদের সঁপে দিতে ইচ্ছুক নয়।

আরও পড়ুন

এ বছরের জানুয়ারি মাসে, দক্ষিণ বিশ্ব বিষয়টিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করছে জাপান, এমন প্রশ্নে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস সচিব যে উত্তর দেন, তা শিক্ষণীয়। তিনি বলেস, ‘জাপান সরকারের কাছে দক্ষিণ বিশ্ব পরিভাষাটির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। আমি যেটা বুঝি তা হলো, সাধারণত উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বোঝাতে এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ বিশ্বের সঙ্গে জাপানের সম্পৃক্ততা শক্তিশালী করার কথা বলেন তিনি।

ব্লুবুক ২০২৩–এ জাপান এ বিষয়টি স্বীকৃতি দিয়েছে যে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলো ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের অবস্থান অনুসরণ করছে না। দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলো পশ্চিমের ‘দ্বিমুখী’ (পশ্চিমাদের শুরু করা যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য, আর অন্যদের শুরু করা যুদ্ধ অগ্রহণযোগ্য) অবস্থানকে দায়ী করা বাড়ছে।

নতুন ব্লুবুকে উল্লেখ করা হয়েছে, জাপান বহুপক্ষীয়বাদকে উৎসাহিত করবে এবং ‘পার্থক্যগুলো ঘোচাবে এমন একটি সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করবে’। এ জন্য নতুন মনোভাব প্রয়োজন।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা সম্প্রতি ইউক্রেন সফর করেন। ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে নিরাপত্তা তথ্য বিনিময়ের উপর জোর দিলেও তিনি আবারও ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান।

  • বিজয় প্রসাদ ভারতের ইতিহাসবিদ, সম্পাদক ও সাংবাদিক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে