কুড়িগ্রামের বেলায় এ বৈষম্যের রহস্য কী

‘কুড়িগ্রামের লোক চাইতে জানে না’—ভিডিও কনফারেন্সে কথাটি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যারা দাবি–দাওয়া উপস্থাপন করেন তাঁরা তো দলীয় নেতা। সেখানে জনগণের দাবি প্রতিফলিত না হওয়ারই কথা।

কুড়িগ্রাম এখন মঙ্গার নয় চাঙ্গার, এখানে খাদ্য উদ্বৃত্ত হয়, কেউ আর না খেয়ে থাকে না—এসবই তো। অভাব থাকলে তো চাইবে।

২০১২ সালে চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ তিস্তা সেতু হওয়ার কথা, তা এখনো শেষ হলো না। কদিন আগে শুনলাম, জুনে চিলমারী-রৌমারী ফেরি চালু হবে। সেই ১৫–২০ দিন পর জুন আসছে, ফেরি চালুর প্রস্তুতি কোথায়? চিলমারীতে মেরিন একাডেমি হবে। তার জন্য খাসজমিতে থাকা প্রভাবশালীদের বাড়ি বাঁচিয়ে আবাদি জমি মাপজোখ করা হলো, প্রস্তাবও গেছে। কই গেল মেরিন একাডেমি? চিলমারী পর্যন্ত কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস যাওয়ার কথা, তার খবর নেই। ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউটের কথা উধাও হয়ে গেছে।

আজ জাপান ভারতের সেভেন সিস্টার্সে পণ্য রপ্তানির কথা বিবেচনায় নিয়ে শিল্পাঞ্চলের যে প্রস্তাব দিয়েছে, এ কথা গণকমিটি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছে। রৌমারীর তাঁতিরা সুতার অভাবে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। অথচ ‘ভোগা তুলা’ নামের একধরনের তুলা চিলমারী-রৌমারীতে উৎপাদিত হতো, সেই তুলার চাষ করা গেলে সুতার চাহিদা পূরণ করা যেত। এমনকি অনেকেই পেশায় ফিরে আসতেন। পাট যেমন বড় কারখানানির্ভর কাঁচামাল, তুলা তেমনটা নয়। তুলা থেকে জামা পর্যন্ত বাড়িভিত্তিক। এ তরিকায় রাষ্ট্রের তরফে কোনো খরচই লাগে না। কিন্তু বিপুল জনগোষ্ঠী স্বাবলম্বী হয়ে যায়। রাষ্ট্রের কাজ শুধু দেখভাল করা। কথা হলো, এখানে যখন টাকাপয়সার কারবার নেই, ফলে...।

সারা দেশে শ খানেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিকল্পনা হলো। কয়েকটি জায়গায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হলোও, কিন্তু এবারও কুড়িগ্রাম নেই। তিস্তা সেতুতে একবার বিদ্যুতের লাইন ঝড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তিন দিন কুড়িগ্রামে বিদ্যুৎ নেই। কারখানাহীন কুড়িগ্রামে শ খানেক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও লাগে না। সেই বিদ্যুৎও কুড়িগ্রামে উৎপাদিত হয় না। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার-গঙ্গাধর—কোথাও কি ৩০০ একর চর নেই, যেখানে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় না?

বর্তমানে দেশে পাবলিক ও সরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫১টি। এর মধ্যে ১টিতে এখনো উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। আর ৩টিতে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। অর্থাৎ কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, তাদেরও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাহলে কুড়িগ্রামের বেলায় এ বৈষম্যের রহস্য কী?

একটা জেএস মাহিন্দ্রা গাড়িতে ৩ লিটার ডিজেল খরচ করে মাত্র ১০ জন যাত্রী বহন করা যায়। যাত্রীপ্রতি নেওয়া হয় ৫০ টাকা। আর একটা মাঝারি নৌকা ৩ লিটার ডিজেল খরচ করে যাত্রী বহন করে ১০০ জন। কিন্তু ভাড়া নেয় ১০০ টাকা। জেএস গাড়ির দাম ৩ লাখ টাকা আর নৌকাটির দাম ২ লাখ টাকা। জেএস মাহিন্দ্রার তুলনায় নৌকার ভাড়া হওয়ার কথা যাত্রীপ্রতি ৫ টাকার কম। তবু নৌকায় বাড়তি ৯৫ টাকা যাত্রীদের দিতে হয় কেন? কারণ, সড়কে বছর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করেও নিলাম ওঠে না, নদীর ডাক ওঠে। জমিদারের মতো ইজারাদারেরা আজও নদীর খাজনা তোলে। চরের ৫ লাখ মানুষসহ পুরো কুড়িগ্রামবাসীকে এ কারণে ভুগতে হয়।

গভীর রাতে ‘চিলমারী কমিউটার’ ফাঁকা চিলমারীতে ফেরে আর সকাল আটটায় চিলমারী থেকে যাত্রী বোঝাই করে ছাড়ে। আগে ৪টা লোকাল চলত, এখন ১টাও না। অথচ বড় গলায় বলা হয়, কুড়িগ্রামের দিকে নাকি বিশেষ নজর।

আরও পড়ুন

২.

‘এ বছর নয়, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শুরু’ শিরোনামে একটি খবর একটি অনলাইন পত্রিকায় এসেছে। ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০২১’ পাস হয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হবে ভোটে জিতে আসার পর?

এখন পর্যন্ত ভিসি কুড়িগ্রামে অফিস পর্যন্ত নেননি, নেননি নিজের থাকার বাসাও। ঢাকা থেকেই সব কাজকর্ম চলছে। পরিত্যক্ত টেক্সটাইল মিলে যে আপাতত ক্লাস বসত, সেখানে এখনো সাইনবোর্ড লাগেনি।

অনুমোদন না মেলায় নাকি চলতি শিক্ষাবর্ষে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কে এম জাকির হোসেন।

উপাচার্য বলেন, এ বছর নয়, পরের সেশনে ভর্তি শুরু হবে। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সেভাবেই চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। গুচ্ছ ভর্তি কার্যক্রমের আওতায় আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে।

আরও পড়ুন

স্থানীয় নেতারা তাঁদের বাড়ির উঠানে, বৈঠকখানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দাবি করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁরা যত তৎপর ছিলেন, তার এক আনাও যদি ক্লাস শুরুর ব্যাপারে উদ্যোগী হতেন, তাহলে ফল আসত বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

এর আগে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০২২-২০২৩) ভর্তি শুরুর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন উপাচার্য জাকির হোসেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান তিনি। মঞ্জুরি কমিশন আর মঞ্জুর করল না।

বর্তমানে দেশে পাবলিক ও সরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫১টি। এর মধ্যে ১টিতে এখনো উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। আর ৩টিতে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। অর্থাৎ কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে, তাদেরও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাহলে কুড়িগ্রামের বেলায় এ বৈষম্যের রহস্য কী?