শীতকালের ইবাদত ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা

শীত ও গ্রীষ্ম আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কুরাইশদের আগ্রহের নিমিত্তে! তাদের অনুরাগ হলো শীত ও গ্রীষ্মে ভ্রমণে। অতএব, তারা যেন ইবাদত করে এই (কাবা) গৃহের প্রভুর জন্য। যিনি তাদের ক্ষুধায় অন্ন দান করেন এবং শঙ্কায় নিরাপত্তা প্রদান করেন।’ (সুরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ১-৪)

আরব দেশের শীতকাল হলো ‘জুমাদা’ মাসদ্বয়, এটি বসন্তের নিকটবর্তী; গ্রীষ্মের পূর্বে। আরবি বর্ষপঞ্জির পঞ্চম মাস হলো ‘জুমাদাল উলা’, ষষ্ঠ মাস হলো ‘জুমাদাল উখরা’। (আল মুনজিদ ও লিসানুল আরব)

হজরত আমের ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘শীতল গনিমত হচ্ছে শীতকালে রোজা রাখা।’ (তিরমিজি: ৭৯৫) হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.)–এর মৃত্যুর সময় তাঁকে তাঁর ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না; বরং রোজার কারণে গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা, শীতের রাতের নফল নামাজ এবং ইলমের আসরগুলোয় হাজির হয়ে আলেমদের সুহবত হারানোর বেদনায় কাঁদছি।’

শীতকালে সঠিকভাবে অজু করা, অজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে—অভাবের দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’

শীতকাল নফল রোজা পালনের সুবর্ণকাল। কাজা রোজা থাকলে তা আদায় করার জন্যও শীতের দিন অতি উপযোগী। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ) ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালে নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ (বায়হাকি) শীত এলে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘হে শীতকাল! তোমাকে স্বাগত! শীতকালে বরকত নাজিল হয়; শীতকালে রাত দীর্ঘ হওয়ায় বেশি নামাজ আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা সহজ হয়।’

শীতকাল এলে উবাইদ বিন উমাইর (রা.) বলতেন, ‘হে কোরআনের ধারক! তোমাদের রাতগুলো তিলাওয়াতের জন্য প্রলম্বিত করা হয়েছে, অতএব তা পড়তে থাকো। আর রোজা রাখার জন্য তোমাদের দিনগুলো সংক্ষেপিত করা হয়েছে, তাই বেশি বেশি রোজা রাখো।’ কোরআনের ভাষায়, ‘তারা রাতের সামান্য অংশই ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকে।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৭-১৮)

শীতকালে সঠিকভাবে অজু করা, অজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে—অভাবের দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত-তাবরানি: ১৪১৪) তিনি আরও বলেন, ‘আমি কি তোমাদের জানাব না? কিসে তোমাদের পাপমোচন করবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবে?’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘অবশ্যই! হে আল্লাহর রাসুল (সা.)!’ তিনি বলেন, ‘শীতের কষ্ট সত্ত্বেও ঠিকভাবে অজু করা।’ (মুসলিম: ২৫১; তাফসিরে কুরতুবি)

শীতকালের জন্য রয়েছে বেশ কিছু স্বতন্ত্র বিধিবিধান। অজুর ক্ষেত্রে পা না ধুয়ে মোজার ওপর মাসেহ করার বিধান রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অজু করে মোজা পরতে হয়। ‘মুসাফির’ (ভ্রমণরত) ব্যক্তি তিন দিন, তিন রাত (৭২ ঘণ্টা) পর্যন্ত মাসেহ করে যেতে পারবেন এবং ‘মুকিম’ (সবাসে অবস্থানরত) ব্যক্তি এক দিন, এক রাত (২৪ ঘণ্টা) মাসেহ করতে পারবেন। এ সময়সীমার পর অজুর প্রয়োজন হলে মোজা খুলে পা ধুয়ে অজু করতে হবে। অনেক মুজতাহিদ ফকিহ শুধু চামড়ার মোজার ওপর মাসেহ করা অনুমোদন করেন।

হজরত মুগিরা ইবনে শুবা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) কাপড়ের মোজা (জাওরাবাইন) এবং জুতার ওপরও মাসেহ করেছেন। (তিরমিজি: ৯৯; আবু দাউদ: ১৫৯) এ হাদিসের ভিত্তিতে অন্যান্য মুজতাহিদ ফকিহ কাপড়ের মোজা ও পুরো পায়ের পাতা আবৃতকারী জুতার ওপর মাসেহ করা অনুমোদন করেন।

শীতকালে গরম পানি দিয়ে অজু করতে যেমন বাধা নেই, তেমনি অজুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে নিতেও বাধা নেই। শীতের তীব্রতা যদি সহ্যের বাইরে চলে যায়, পানি গরম করে ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে এবং ঠান্ডা পানি ব্যবহারে শারীরিক ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা থাকে, তাহলে অজু ও গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করতে পারেন। (বায়হাকি, খণ্ড: ১, হাদিস: ২২৬)

শীতকালে গরম পোশাক পরা সুন্নত। হজরত উমর (রা.) তাঁর শাসনামলে গভর্নরের উদ্দেশে শীতের আগমনে লিখতেন, ‘শীত এসে গেল, এ তোমাদের দেহের শত্রু। অতএব, এর প্রতিরোধে পশমি বস্ত্র, মোজা, হাতমোজা ইত্যাদির প্রস্তুতি নাও। আর পশম দিয়ে গায়ের চামড়ায় ও শরীরের পোশাকে শীতের আক্রমণ ঠেকাও। কারণ, শীত খুব দ্রুত প্রবেশ করে, তবে সহজে বিদায় নেয় না।’

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

  • যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

  • [email protected]