সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচনব্যবস্থাই কি আমাদের ভবিতব্য

রাষ্ট্রপতি থেকে নিঃস্ব (ফ্রম প্রেসিডেন্ট টু পপার)—প্রত্যেক ভোটারই ভোট প্রদানে বিধি মতে একই আড়াল দাবি করেন। এই আইনি আড়াল নিশ্চিত করতে কাপড় ঘেরা স্থানে টিক দিয়ে ঠিক করতে হয় সংসদ সদস্য। প্রকাশ্যে ভোট দিয়ে এ আড়াল (আইনি) অমান্য করায় সদ্য শপথ নেওয়া ধর্মমন্ত্রীকে তলব করেছে নির্বাচন কমিশন।

‘ভোট’ একটা চয়ন পদ্ধতি। এতে আবেগ কাজ করে, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক থাকার দক্ষতা আসলে অর্জন করতে হয়। নানা নাগরিক অনুশাসন অনুশীলন প্রয়োজন এই দক্ষতা অর্জনে। ভোটাররা হচ্ছেন নির্বাচক, তাঁরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ওই এক দিনই।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে কতগুলো শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তার অন্যতম গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মানবাধিকার আইনের শাসন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৌল উপাদান। নির্বাচনপূর্ব এসব মানদণ্ড ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয় কি না, সে প্রশ্নে উত্তরহীন থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। এসব শর্তের উপস্থিতি ইলেকটোরাল ইথোস বা নির্বাচনী নীতি প্রতিষ্ঠা করে।

আরও পড়ুন

দ্য থার্ড ওয়েভস: ডেমোক্র্যাটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি বইয়ে স্যামুয়েল পি হান্টিংটন এক তত্ত্বকে জনপরিসরে নিয়ে আসেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। এর ছাঁচে ফেলে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পরীক্ষা করা যায়, যার নাম ‘দুবার হাতবদলের পরীক্ষা’ (টু টার্নওভার টেস্ট)। তাঁর এ তত্ত্বমতে, একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ নিয়েছে কি না, সেটা পরিষ্কার হবে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সংশ্লিষ্ট দেশ পরপর দুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারে, যাতে ক্ষমতার পালাবদল হয় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া। পরাজিত পক্ষ ভোটের ফলাফল মেনে নিয়েছে কি না এবং বিজয়ী দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের থেকে দূরে আছে কি না, সেটাই গণতন্ত্রায়ণের নির্ধারক লিটমাস টেস্ট।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন আইনত প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। এবারে নির্বাচন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ন্যূনতম সহিংসতায় হয়েছে তার কৃতিত্ব নির্বাচন কমিশন দাবি করতে পারে। এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ যে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ইস্যুতে নির্বাচন কমিশন বা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের করার কিছু আসলেই ছিল কি? আর এ বিষয় সর্বজনবিদিত যে গণতন্ত্র থেকে সর্বোত্তম ফল তখনই পাওয়া যায়, জনগণ যখন হন শিক্ষিত। রাষ্ট্র এবং নিজেদের ভালোর ব্যাপারে যুক্তিসংগত চিন্তার ক্ষমতা যখন তাঁদের থাকে।

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মেনে চারটি নির্বাচনের নজির ছিল না। তা হয়েছে, কিন্তু নির্বাচনী নীতি বা ইলেকটোরাল ইথোস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? বাংলাদেশের পথচলা অর্ধশতকের বেশি সময়। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অন্যতম নির্বাচন কমিশন। তা সত্ত্বেও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নয় যে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধির অভাব আছে।

পঁচাত্তর-পরবর্তী দেড় দশকের শাসনের পর নব্বইয়ে বড় দলগুলোর ঐকমত্য ছিল, কারণ তখন অভিন্ন প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু বড় দল দুটি যখন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন আসলে আর সে ঐকমত্য থাকেনি। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে এই জটিলতা, এমন সংশয় কি স্বাভাবিক?

২০০৮ সালের পরের নির্বাচনগুলো বিভিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন ছিল আসল ‘কাজী’। এবারের নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমে কমিশন গঠন করা হয়। রুলস অব গেম কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ফলাফল একই।

২০০৮ সালের পরের নির্বাচনগুলো বিভিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন ছিল আসল ‘কাজী’। এবারের নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমে কমিশন গঠন করা হয়। রুলস অব গেম কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ফলাফল একই।

 এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের ১২টি নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়া ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৭ শতাংশ। আর এবার নির্বাচন কমিশনের দাবি ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচনে জয় পেতে ন্যূনতম ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ ভোট প্রদানের হার ১ শতাংশ হলেও সে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সে কারণে বেশির ভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাতে ভোটের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। 

আরও পড়ুন

নির্বাচনের আগে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক সরকারের পরিচালনায় থাকে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের অধীন ন্যস্ত হওয়া উচিত। যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও ক্ষমতা প্রয়োগের মনস্তাত্ত্বিক সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব হয় না। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সংস্কার না হওয়ায় নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার শিথিলতা অনেক দিনের সমস্যা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান ও বিধিবিধান পরিবর্তিত হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ ‘বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি বিকল্প’ শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন, যেকোনো ধরনের দৃশ্যকল্প বিবেচনার সময় এটা মনে রাখতে হবে যে কোনো সমাজের বা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত নয়। যেকোনো ধরনের ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরি করার বিষয়। একটি দেশের নাগরিকেরা যত বিরূপ পরিবেশই মোকাবিলা করুন না কেন, ভবিষ্যৎ তাঁরাই তৈরি করেন। নাগরিকদের সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তাই হচ্ছে পথরেখা নির্ধারণের মূল চালিকা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্মিত হয় না, আর রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবী বলে কিছু নেই (সূত্র প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০২১)।

দলের মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচন করায় বহিষ্কার করা হয়েছে আগে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়েছে বরং তার উল্টো। স্বয়ং দলের প্রধান দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। স্বাভাবিক বিশ্লেষণ বলে এর পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। দ্বিতীয়ত, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। আওয়ামী থিংকট্যাংক মনে করেছে, দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর পাশাপাশি মনোনয়নবঞ্চিত শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে, যা বহির্বিশ্বে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলে বার্তা দেওয়া যাবে। এমন আত্মপ্রসাদ কি প্রকৃত রাজনৈতিক পুঁজি?

  •  এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট