কর্মবাজারে চাহিদা না থাকলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়

ড. মো. আহসান হাবীব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) অধ্যাপক। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন চলমান এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেলেঙ্কারি এবং শিক্ষার সার্বিক হালচাল নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

মো. আহসান হাবীব

প্রশ্ন :

এবার এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে কেলেঙ্কারি হলো, যাতে সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ আছে; আরেকটি প্রশ্নপত্রে একজন কথাসাহিত্যিককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মো. আহসান হাবীব: গতানুগতিক প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন এক নয়। গতানুগতিক প্রশ্ন যে কেউ তৈরি করতে পারেন। কিন্তু সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়। প্রস্তুত করতে হয়। সরকার যখন সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করল, তখন আর এই কাজগুলো ভালোভাবে হয়নি। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে কিছু প্রশিক্ষণ হয়েছে; যাঁরা প্রথমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষকেরা প্রকৃত প্রশিক্ষণটি পাননি। প্রশ্ন তৈরির সময় যে সামাজিক বাস্তবতা, শিক্ষার্থীদের বয়স, নৈতিকতাবোধ বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, এ ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। আর যে কথাসাহিত্যিকের উদাহরণ আনলেন, সে ক্ষেত্রেও অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না, আমি বলতে পারব না। অনেক সময় শিক্ষকেরা তাড়াহুড়া করেন, মনগড়া একটি প্রশ্ন তৈরি করেন; দায়িত্বহীনতার কারণেই এসব হয়। অতীতেও সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।

প্রশ্ন :

সমস্যা তো শুধু সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে নয়। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই তো বেহাল।

আহসান হাবীব: দেখতে হবে কারা শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। যাঁরা অন্য কোনো চাকরি পান না, সাধারণত তাঁরাই শিক্ষকতায় আসেন। সব চাকরিতেই মেধাবীদের অগ্রাধিকার থাকা দরকার। এ জন্য উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে। ভালো ছাত্র হলেই ভালো শিক্ষক হবেন—এমন নয়। শিক্ষকতায় তাঁর অভিনিবেশ আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। একাডেমিক জ্ঞান যাঁদের বেশি, তাঁদেরই শিক্ষকতা সেবায় আসা উচিত। কিন্তু আমরা তো দেখি, একাডেমিকভাবে যাঁরা পিছিয়ে থাকেন, তাঁরা শিক্ষকতায় আসেন।

প্রশ্ন :

সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। বলা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু সেটি কি সফল হয়েছে?

আহসান হাবীব: আমাদের অর্জিত জ্ঞান ছিল পুঁথিগত। আমরা শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যায় উৎসাহ দিয়ে আসছি। প্রশ্নগুলোও সেভাবে হতো। কোন বইয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর আছে, সেটাও শিক্ষকেরা দাগ দিয়ে দিতেন। সে ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি বা প্রশ্ন অবশ্যই জরুরি ছিল। প্রশ্নের চারটি ধাপ আছে। শেষ ধাপে এসে শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, সে কী শিখল? এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা বা ছকও দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যদি বিষয়টি বুঝতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে প্রশ্ন করবেন?

প্রশ্ন :

এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?

আহসান হাবীব: বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, শিক্ষার মানোন্নয়নে দুটি কাজ করা প্রয়োজন। প্রথমত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষকতা পেশায় যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁদের নিয়োগ করতে হবে। আমি শিক্ষা মনোবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি। কোনো ব্যক্তির শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ আছে কি না, সেটি বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে জেনে নেওয়া যায়। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হলে এটা করতেই হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন কী দেখা হয়—প্রার্থীদের সাধারণ জ্ঞান, পঠিত বিষয়ের ওপর জ্ঞানের মান ইত্যাদি।

প্রশ্ন :

আপনারা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন। শিক্ষা প্রশাসনে যাঁরা আছেন বা নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা কি এসব গবেষণাকে আমলে নেন? আপনাদের কথা শোনেন?

আহসান হাবীব: তাঁরা আমাদের কথা শোনেন না। দুই পক্ষ থেকেই ঘাটতি আছে। আমরা যেসব গবেষণা করি, সেসব তাঁদের জানাতে পারছি না। এখানে একটা ঘাটতি আছে। আমাদের জার্নালগুলোর অনলাইন সংস্করণ নেই। তাহলে কতজন সেটি দেখতে পান? আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করার কথা বলছি। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ক্ষেত্রে যে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকা দরকার, সেটা হয়নি। সামর্থ্যেরও অভাব আছে।

প্রশ্ন :

এ মুহূর্তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যা কী বলে মনে করেন?

আহসান হাবীব: অনেক সমস্যা আছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—প্রতিটি স্তরেই সমস্যা আছে। যেমন খুব শিগগির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। কারা নিয়োগ পাবেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এরপর তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোয় লোকবলসংকট আছে। প্রথম আলোর খবরেই দেখলাম, অর্ধেকের বেশি পদ খালি আছে। তাহলে প্রশিক্ষণ কীভাবে হবে? এই শিক্ষকেরা কোনোরকমে একটা প্রশিক্ষণ সনদ নিয়ে যাবেন। শিক্ষকজীবনের শুরুতেই তাঁদের ফাঁকি দেওয়া হলো। যদি আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই—শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, অবকাঠামো উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপে কোনো কাজ হবে না।

প্রশ্ন :

অভিযোগ আছে, শিক্ষার প্রতি সরকার যথেষ্ট নজর দিচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ সবচেয়ে কম।

আহসান হাবীব: আমি বলব, সরকার নজর দিচ্ছে। কিন্তু যেখানে যখন যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না। বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন, এ কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমি বরাদ্দের চেয়েও গুরুত্ব দিতে চাই নেতৃত্বে। শিক্ষায় যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তঁাদের যোগ্য হতে হবে। যোগ্য নেতৃত্বই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে।

প্রশ্ন :

আমাদের প্রয়োজন ছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করা। সরকার সেটি না করে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করছে। এটা কতটা সমীচীন বলে মনে করেন?

আহসান হাবীব: সরকার যে নামে বিশ্ববিদ্যালয় করছে, অর্থাৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলোর প্রয়োজন আছে। তবে দেখার বিষয় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিশেষায়িত শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রথম আলোতেই খবর বের হয়েছিল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিশেষায়িত বিষয়ই বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই হবে না, চাকরির বাজারে তার চাহিদা আছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

এই মুহূর্তে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। জামালপুরে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুর্নীতি, কর্মকর্তা নিয়োগসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ইউজিসির গাইডলাইন বা নির্দেশনা সংশোধনের দাবিতে।

আহসান হাবীব: দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করি না! তবে একজন নাগরিক হিসেবে বলব, সব খাতে দুর্নীতি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও তার বাইরে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-পদোন্নতিতে রাজনীতির চেয়ে জ্ঞান ও মেধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন :

কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনাই তো অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে।

আহসান হাবীব: এটা হলে মেধাবী শিক্ষকেরা থাকবেন না। চলতি বছরেই আইইআরে তিনজন শিক্ষক বিদেশে চলে গেছেন। তঁারা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এখানে এসেছিলেন শিক্ষকতা করতে। মেধাবীরা চলে যাওয়া মানে দেশ তাঁদের ধরে রাখতে পারছে না। এটা বড় ক্ষতি।

প্রশ্ন :

মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদেশে চলে যাওয়া তো একধরনের মেধা পাচার। এ নিয়ে আপনারা কোনো গবেষণা করেছেন কি?

আহসান হাবীব: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে একটি গবেষণা হয়েছে, যা এখনো প্রকাশিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা বেশি হওয়ার কারণে মেধাবীরা পেছনে পড়ে যাচ্ছেন, দূরে সরে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন :

আর ইউজিসির গাইডলাইন সম্পর্কে কী বলবেন?

আহসান হাবীব: র‌্যাঙ্কিং বাড়ানোর জন্য যখন ইউজিসি বা অন্য প্রতিষ্ঠান গাইডলাইন চাপিয়ে দেয়, তখন দেখা প্রয়োজন সেই গাইডলাইন বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আছে কি না। আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রবন্ধ ছাপাতে হবে। কিন্তু সেই প্রবন্ধের জন্য যে বইপত্র সংগ্রহ করতে হবে, গবেষণা করতে হবে, সেই সুযোগটা এখানে আছে কি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই বিদেশি জার্নাল বা বইপত্র কম। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সীমিত। শ্রেণিকক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চেহারা দেখে আমাদেরও মনে হয়, এসব গবেষণা ও শিক্ষা বেশি কাজে আসবে না। যে কক্ষে দুজন শিক্ষার্থী থাকার কথা, সেখানে আছে ছয়জন। থাকা-খাওয়া ঠিক না থাকলে তারা পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে কীভাবে। তাই গাইডলাইনের পাশাপাশি গবেষণার সুযোগও তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন :

এইচএসসিতে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। ফলাফলে দেখা যায় বেশির ভাগ ন্যূনতম নম্বর পান না। এর কারণ কী?

আহসান হাবীব: আমাদের পাবলিক পরীক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি পরীক্ষা—দুটোতেই পদ্ধতিগত ভুল আছে। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এখনো মুখস্থনির্ভর। যে ভালো মুখস্থ করতে পারে, সে–ই বেশি নম্বর পায়। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু শিক্ষার্থীর প্রবণতা বা আগ্রহ যাচাই করে ভর্তি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেসব প্রশ্ন করেন, তার মান হয়তো ভালো। কিন্তু সেই প্রশ্ন থেকেও জানা যায় না কোন বিষয়ে শিক্ষার্থীর আগ্রহ বেশি। আমি মনে করি, সমন্বিত পরীক্ষা হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে দুটির পরীক্ষারও প্রয়োজন হয় না।

প্রশ্ন :

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বলবেন কি কোভিড শিক্ষা ক্ষেত্রে কতটা আঘাত সৃষ্টি করেছে?

আহসান হাবীব: কোভিডের কারণে প্রায় দুই বছর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দী ছিল। দুই বছর পর এসে শ্রেণিকক্ষের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। আবার শিক্ষকও বুঝতে পারছেন না শিক্ষার্থী কতটা নিজেকে তৈরি করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আচরণেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই ও পরীক্ষার বাইরে যেতে পারছে না। আমরা যাদের ভালো ছাত্র বলি, তারা কতটা মেধাবী, সেটা যাচাই করা যায় না। বরং বলতে পারি ভালো নম্বর অর্জনকারী। এতে অন্যদের মধ্যে হীনম্মন্যতা দেখা যায়। আমাদের কারিকুলামে কিন্তু পাঠ্যবইবহির্ভূত অনেক বিষয়ের কথা আছে। কিন্তু পরীক্ষা না থাকায় অভিভাবকেরাও সেসব বিষয়ে আগ্রহ দেখান না। সন্তানদের নম্বর পাওয়ার ওপরই জোর দেন। খেলাধুলা, বিতর্ক, সংস্কৃতি চর্চা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি মনে করি, নম্বর দেওয়ার বিষয়টি তুলে দেওয়া উচিত। আমাদের পরীক্ষা বা নম্বরভিত্তিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন :

মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হচ্ছে। এতে বড় ধরনের পরিবর্তন আছে কি?

আহসান হাবীব: জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বেড়ে যাওয়ায় আগের শিক্ষাক্রম বাতিল হয়ে যায়। নতুন কারিকুলাম তৈরি করতে হয়। আগেও আমাদের কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়েছে। নীতির দিক থেকে এটি ঠিকই আছে। জ্ঞান বা প্রয়োজনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাস্তবায়ন হবে কি না। আগের কারিকুলামেও কিন্তু ‘নিজের কাজ নিজে করি’ কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু আমরা বাস্তবে কি তা দেখতে পেয়েছি? বাস্তবায়নের জন্য যে সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন, তা আছে কি না। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের জন্য বছরে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সেই বরাদ্দ অন্য খাতে ব্যয় করে।

প্রশ্ন :

নতুন কারিকুলামে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ তুলে দেওয়া হয়েছে। অনেকে এ নিয়ে সমালোচনাও করেছেন।

আহসান হাবীব: আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্ত সঠিক। আমরা ক্লাসে দেখি, যারা মানবিক বিভাগ থেকে এসেছে, তারা বিজ্ঞানের ন্যূনতম ধারণাও রাখে না। তারা ধরে নেয় যে বিজ্ঞান তাদের জানার প্রয়োজন নেই। উচ্চশিক্ষায় সেই বিজ্ঞান পড়ুক না পড়ুক বিজ্ঞান বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান সব শিক্ষার্থীর থাকতে হবে। একইভাবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এ সাহিত্য সংস্কৃতি ও সুকুমারবৃত্তি-সংস্কৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেদিক থেকে নতুন কারিকুলাম সব বিভাগের শিক্ষার্থীকে ঋদ্ধ করবে। আমরা তো ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়তে চাই। সে ক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে বিজ্ঞানের বাইরে রাখা সমীচীন বলে মনে করি না।

প্রশ্ন :

অর্থ পাচার নিয়ে আমরা যত কথা বলি, মেধা পাচার নিয়ে বলি না। কিন্তু মেধা পাচারের ক্ষতি আরও বেশি।

আহসান হাবীব: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে মেধাবীরা যদি সঠিক কাজের সুযোগ পায়, তাহলে সেখানে থাকতে রাজি হবে। যে যেই ক্ষেত্রে আছে, সেই ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ দিতে হবে। কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে মেধাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সাম্প্রতিক কালে একটি ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা গেছে, বাংলাদেশে তৃতীয় প্রজন্মের অনেক মেধাবী মানুষ বাইরে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসেছেন। যঁারা বাইরে বড় হয়েছেন, তাঁরা দেশে এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।

প্রশ্ন :

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর সামনে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল। এখন নেই কেন?

আহসান হাবীব: অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভিসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের জটিলতা আছে। আমাদের বিভাগে একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী দেড় বছর ধরে চেষ্টা করছেন। তাঁকে নানা কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পাননি। আমরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেলে কিন্তু এত কিছু লাগে না। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে পারলে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী এখানে আসবেন। তাঁরা বাংলাদেশের সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে জানতে পারবেন।

প্রশ্ন :

শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে কী করণীয়?

আহসান হাবীব: আমি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী হিসেবে বলব, আমাদের এখানে শিক্ষাটা আনন্দদায়ক করতে পারিনি। শিক্ষার মানের জন্য সেটি খুবই প্রয়োজন। একটি উদাহরণ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সকালে গেলে দেখবেন, দীর্ঘ ব্যাগের লাইন। সবাই বিসিএসের বই খুলে পড়ছেন। তঁারা মনে করেন, বিসিএস দিয়ে ভালো চাকরি পাবেন। তঁারা যে বিষয়ে পড়ছেন, সে বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষার্থীর প্রয়োজন নেই। কম শিক্ষার্থীকে উন্নত শিক্ষা দেন। বেশি শিক্ষার্থীকে দায়সারা শিক্ষা দিয়ে লাভ নেই।

প্রশ্ন :

শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা শিক্ষা প্রশাসনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কি ঘুচবে, না এভাবে চলতে থাকবে?

আহসান হাবীব: শিক্ষা প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরাই শিক্ষাকে নেতৃত্ব দেন। তাঁরাই মান নির্ধারণ করেন। ফলে প্রশাসন যদি রাজনীতিকে সামনে না এনে শিক্ষাকে সামনে আনে, তাহলে শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে যাবে। শিক্ষাঙ্গনেও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকবে।

প্রশ্ন :

আপনাকে ধন্যবাদ।

আহসান হাবীব: আপনাকেও ধন্যবাদ।