শব্দদূষণ নাকি শব্দসন্ত্রাস: নতুন এই ‘মাথাব্যথার’ ওষুধ কী?

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকায় বর্তমানে মারাত্মক উপদ্রব হয়ে ওঠা শব্দদূষণকে এখন অনেকেই ‘শব্দসন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করছেন। এই ‘শব্দসন্ত্রাস’ অনেকটা নীরবে জনস্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। নতুন এই ‘মাথাব্যথা’র বিষয়ে এখনই জোর তৎপরতা নেওয়া না হলে জনগণকে চরম মূল্য দিতে হবে।

সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দকেই শব্দদূষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। নীরব ঘাতক শব্দদূষণের ফলে শিশু, বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও অসুস্থ ব্যক্তিসহ সব বয়সী মানুষের মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকি বাড়ছে।

শব্দদূষণের কারণে ঢাকার ‘মর্যাদা’ এখন বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম বা দ্বিতীয়। শব্দদূষণের উৎসগুলো হলো বিভিন্ন যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন, নির্মাণকাজে উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহার, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার, নির্বাচনী প্রচারণা ও পটকা বিস্ফোরণের উচ্চ শব্দ।

চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য ও আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা সৃষ্টি করে। অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত শব্দ একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শব্দদূষণ মানসিক উদ্বেগ, বিরক্তি, উচ্চ রক্তচাপ, ঘুমের ব্যাঘাতের পাশপাশি নানা রকম ক্ষতিকারক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি জটিলতা তৈরি করে। শব্দদূষণের ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যায় ও ক্রমান্বয়ে বধিরতার দিকে ঠেলে দেয়।

কানের ভেতর ঝিঁঝি শব্দ, মাথাব্যথা, অস্বস্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়। হৃৎপিণ্ডের নাড়ির গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রমাগত শব্দদূষণের মধ্যে থাকলে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, স্মৃতিভ্রংশতা তৈরি হয়। শব্দদূষণের ফলে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দদূষণের প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়ে গর্ভবতী মায়েদের ওপর। গর্ভবতী মায়ের কানের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। মা যখন উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন, ঘুম ঠিকমতো না হলে এর প্রভাব বাচ্চার ওপর পড়ে। শেষের তিন মাস গর্ভের বাচ্চারা বাইরের শব্দ শুনতে পায়। উচ্চ শব্দে তাদেরও হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এতে বাচ্চাদের শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে, এমনকি সময়ের আগেই প্রিম্যাচিউর বাচ্চার জন্ম হতে পারে। এ জন্য গর্ভবতী মায়েদের ৮৫ ডেসিবলের অধিক শব্দের স্থানে যেতে বারণ করা হয়।

একজন ভুক্তভোগীর কথা

এবাদুল ইসলাম (ছদ্মনাম) একজন ব্যাংকার। ১০টা-৬টা অফিস সূচি তাঁর জন্য কেবলই একটা লিখিত নিয়ম। দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজ শেষে রাত ৯টার আগে ঘরে ফেরা হয় না তাঁর। বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি, উপরন্তু শাখাপ্রধান হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে তাঁকে অফিসে একটু বাড়তি সময় দিতে হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর এলাকায় তিন দফা ধর্মীয় জলসা, দুবার বিয়ের গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে বড় রাজনৈতিক দলের সভা–সমাবেশের মাইকে ভেসে আসা জ্বালাময়ী বক্তব্যও শুনতে বাধ্য হন তিনি। তাঁর ঘরে বৃদ্ধা মা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী, স্কুল ও কলেজপড়ুয়া দুই সন্তান। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম স্বাস্থ্যগত জটিলতায় নিদ্রাহীনতার চিকিৎসা চলমান তাঁর স্ত্রীর। আর ব্যাংকের চাকরির সুবাদে উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে সুগারের সমস্যাটা চলে এসেছে। আটাশ দিনের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট আট দিন তাঁর এলাকায় লাউডস্পিকার ও মাইক বেজেছে গড়ে রাত একটা অবধি।

ধর্মীয় জালসা বিকেলে শুরু হয়ে প্রতি পর্বে দুই দিন করে ছয় দিন চলেছে রাত ১২টা পর্যন্ত। সভার আয়োজনস্থল প্রায় এক কিলোমিটার দূরে হলেও প্রতিবারই একটা মাইক এবাদুল সাহেবের বাসার কাছে গলির মুখে লাগানো হয়। তীব্র শব্দের অত্যাচারে ঘুমাতে না পেরে তাঁর অসুস্থ মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন, বাচ্চা দুটি পড়ালেখায় ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারেনি। ঘুমের ওষুধ সেবনেও ঘুম আসেনি এবাদুল সাহেবের স্ত্রীর। ফলে জটিলতা আরও তাঁর। আর ঘরে বাচ্চাদের লেখাপড়া, ইবাদত-বন্দেগি করা সম্ভব হয় না ঠিকমতো।

আরেক দিন এলাকাবাসীর সুবিধা–অসুবিধার কথা না ভেবে কয়েক বাড়ি পর গলির এক বাড়িতে গায়েহলুদের লাউডস্পিকারের অত্যাচার চলে রাত আড়াইটা পর্যন্ত। দরজা–জানালা বন্ধ করেও শব্দের অত্যাচারে ঘুমাতে না পেরে বাধ্য হয়ে তিনি ফোন করেন জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন নম্বর ৯৯৯–এ। সোয়া দুইটা পর্যন্ত চেষ্টা করেও একই উত্তর পেয়েছেন, ‘আমাদের সব এজেন্ট এখন ব্যস্ত আছেন।’ এমন একটা ভয়ংকর রাত উপহার পাওয়ার পর সকালবেলা আর ওঠা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। একটু বাড়তি ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে তবেই বিলম্বে অফিসে যেতে হয়েছে এবাদুল সাহেবকে।

দেশের আইনে কী বলা আছে

বাংলাদেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) অনুয়ায়ী নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা ও মিশ্র এলাকা—এই পাঁচটি জোনে দিনে ও রাতে আলাদা করে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নীরব এলাকার জন্য দিনের বেলায় ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল মাত্রা দেওয়া আছে। আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ আর রাতে ৪৫ ডেসিবল। এখানে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,ক. ভোর ৫টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত সময় ‘দিবাকালীন সময়’ হিসেবে চিহ্নিত।
খ. রাত ৯টা হতে পরবর্তী সকাল ৬টা পর্যন্ত সময় ‘রাত্রিকালীন সময়’ হিসেবে চিহ্নিত।

এদিকে আইনে ‘নির্মাণসামগ্রী (ইট ও পাথর) ভাঙার মেশিন আবাসিক এলাকার ৫০০ গজের মধ্যে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত চালানো নিষেধ’ বলা হয়েছে।

বিধিমালার ৭ নম্বর ধারায় ‘শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম নিষিদ্ধ’–এর বর্ণনায় বলা হয়েছে, অনুমতিপ্রাপ্ত না হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো এলাকায় শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না।

দেখা গেছে, এ দেশে যেসব রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠান আবাসিক এলাকায় আয়োজিত হয়, এর জন্য কখনোই কারও অনুমতি নিতে হয় না, এমনকি অনুমতি নেওয়ার যে একটা বিধি বা আইন আছে, তা–ও বেশির ভাগ মানুষ জানে না। যদি কেউ জেনেও থাকে তারা এসবের তোয়াক্কা করে না।

  • মুহাম্মদ লুৎফুল হায়দার ব্যাংকার