‘অফিস পলিটিকস’ আজ এক বিশেষ বাস্তবতা। শব্দবন্ধটি বাংলা শব্দের মতো হয়ে গেছে। ‘অফিস পলিটিকস’-এর বদলে যদি ‘অফিস রাজনীতি’ বলা হয়, তাহলে এর আসল অর্থ ধরা যাবে না।
‘রাজনীতি’ শব্দটির অর্থ দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু এর আলো আজও পুরোটা নিভে যায়নি। ‘পলিটিকস’ শব্দের ভেতর কুটিলতার গন্ধ পাওয়া যায়। যেমন ভিলেজ পলিটিকস।
অফিসের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব বিমূর্ত বিষয় নয়। এর ভেতরে ঢুকলে সহজে তা টের পাওয়া যায়। অফিস হলো ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, সুযোগ-সুবিধা, পদপদবির জায়গা। অফিসে নানা স্তরে ক্ষমতা থাকে, যা মূলত বসকেন্দ্রিক।
‘বস’ শব্দের ভেতর রয়েছে এক কর্তৃত্ববাদী দ্যোতনা। আমাদের অফিসগুলো মূলত ভার্টিক্যাল ক্ষমতা কাঠামোর। এখানে ক্ষমতা থাকে ওপরের দিকে।
অন্যদিকে, হরাইজেন্টাল আদলের অফিস কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভারসাম্য থাকে।
অফিসে ঢুকে নিমেষেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিবেশ বোঝা গেলে ধরে নিতে হবে এটি পলিটিকস–নির্ভর অফিস। এখানে পেশাদারি দূরবর্তী বিষয়।
মনে রাখতে হবে, নিয়োগ পেলেই বস মানোত্তীর্ণ হয়ে যান না। মান তাঁকে প্রমাণ করতে হয়। তবে কিছু উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, পেশাদার বস যে নেই, তা নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা কম।
অফিস পলিটিকস ম্যানেজ করতে কর্মীদের নেহাত কম সময় ব্যয় করতে হয় না। কর্মপরিবেশে কর্মজীবীদের জন্য বরাদ্দ জায়গা কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা পরিমাপের প্রাথমিক সূচক।
এ ছাড়া রয়েছে কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন। চেয়ার-টেবিল ও কম্পিউটার, ফিক্সচার-ফার্নিচারের বরাদ্দ ইত্যাদি।
ভার্টিক্যাল অফিস কাঠামো বসদের অভয়ারণ্য। এখানে কর্মীরা আট ঘণ্টা সময় কাটান অফিস পলিটিকসের ভেতর। আর আট ঘণ্টা অফিসের বাইরে এক ধরণের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ছায়ার নিচে।
অবশিষ্ট আট ঘণ্টা পারিবারিক পরিবেশে। কর্মজীবীদের ওপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এটি এক ঘণ্টাভিত্তিক বিভাজন।
অফিসগুলোতে লিডারের সংখ্যা কম। লিডারেরা প্রগতির প্রতীক। তাঁরা কর্মপ্রবাহ এগিয়ে নেন। অন্যদিকে, বসদের কাজ বসগিরি করা। আমাদের অফিসগুলো বসসর্বস্ব।
বসেরা কর্মী হায়ার, ফায়ার, প্রোমোশন ও ডিমোশন নির্ধারণ করেন। এ চার মাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বসের মর্জি। বসনির্ভর অফিস একটি খুশিকরণ প্রকল্প। বসকে খুশি রাখতে হয়।
অফিস পলিটিকসের একটি প্রধান দিক হলো বসকেন্দ্রিক নেক্সাস। এ কেন্দ্রটা চিনে নেওয়া জরুরি।
কারণ, অফিসের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার মূল ক্রীড়নক তিনি। কর্মীদের বসের মর্জি ধরে রাখতে হয়, সন্তুষ্ট রাখতে হয়।
তবে কাজ করে বা দায়িত্ব পালন করে যে বসকে সব সময় খুশি রাখা যাবে, বিষয়টি এমনটি নয়। তারা কিসে খুশি বা অখুশি, তা বোঝা সহজ কাজ নয়।
গড় বসদের সুনির্দিষ্ট সন্তুষ্টি বলে কিছু নেই। গিরগিটির মতো তাঁরা রং বদলান। তাঁদের চরিত্র অনুমান করা কঠিন। কাজ নিয়ে বোঝাপড়ার ঘাটতি, নেতৃত্বের দুর্বলতা ও পেশাদারি উৎকর্ষের অভাবে তাঁরা মূলত জটিল প্রকৃতির হন। দায়িত্ব চালিয়ে নেওয়ার জন্য অফিস পলিটিকস প্রোমোট করেন।
এটি তাঁদের একটি বিশেষ কৌশলও বটে।
একজন লিডার চাইলে অফিস পলিটিকসকে সহনশীল মাত্রায় রাখতে পারেন। অন্যদিকে, একজন বস সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান নেন। অফিসে পলিটিকসে নানা ধরনের খোপ সাজান। কাকে কীভাবে ‘সাইজ’ করবেন, চাপে রাখবেন, তা স্থির করেন। কর্মীদের মধ্যে যেসব সংবদ্ধতা থাকে তার কলকাটি নাড়েন।
বসের নখ দর্শনের বাইরে অফিসগুলোতে তেমন কিছু ঘটে না। এখানে সরাসরি যোগাযোগের চেয়ে আড়ালে-আবডালে যোগাযোগ ঘটে বেশি। তিনি উদাহরণ রেখে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান না।
তাঁর যোগাযোগের একটি বিশেষ কৌশল হলো ব্যাক বাইট করা। অর্থাৎ একজন কর্মীর অনুপস্থিতিতে অন্য কর্মী নিচু কথা বলা যাকে পশ্চাৎ দেশে কামড় বলে অনেকে অবহিত করেন।
অফিস পলিটিকসের যোগাযোগীয় দিক ভিন্ন মাত্রার। স্বার্থ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে টিকে থাকার জন্য দারুণ সব যোগাযোগীয় দক্ষতা রপ্ত করতে হয়। অনেকের ভেতর এসব যোগাযোগীয় গুণাবলি সহজাতভাবে থাকে, অনেক আবার কষ্ট করে রপ্ত করেন।
এ ধরনের যোগাযোগ ঘটে চুপে চুপে খুব পারচুয়েসিভ ঢঙে (অনেকে এ ধরনের যোগাযোগকে ‘ঘুপি কমিউকেশন’ বলে অভিহিত করেন)।
অফিস পলিটিকসে ম্যানেজ করা লাগে। আর ম্যানেজের বিষয়টি তো এমনি এমনি হয় না। এর জন্য লাগে অভিযোজন ক্ষমতা, স্কিলস—যা বসের গুডবুকে ঢুকতে সহায়তা করে।
এ ধরনের যোগাযোগীয় দক্ষতা অর্জন আজকের বাস্তবতায় একেবারে উপেক্ষার বিষয় নয়।
বসের মনোভঙ্গির রসায়ন ভাঙলে দেখা যায়, কাজের চেয়ে নির্ভেজাল আনুগত্যের প্রতি তার মনোযোগ বেশি। অফিসে ও বাইরে তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজগুলো কে কত ভালোভাবে করতে পারছেন, সেটিও তিনি আমলে নেন।
অফিস পলিটিকসে দক্ষ কর্মীদের তুলনায় অদক্ষরা এগিয়ে থাকেন। চাকরি টিকিয়ে রাখতে নানা কৌশল রপ্ত করতে হয়। বসের সাধনাই তাঁদের প্রধানতম তৎপরতা। বস তাঁদের পছন্দ। কারণ, এ ক্ষুধা তাঁর প্রবল।
হুমায়ুন আজাদ একদা বলেছিলেন, মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।
অদক্ষদের মানমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ববোধ কম হয়। অন্যদিকে দক্ষ কর্মীদের ভেতর দক্ষতাকে ঘিরে একধরনের অহংবোধ থাকে। তাঁরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু বস তো কেবল কাজ চান না, আনুগত্য চান, বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা চান।
দক্ষ কর্মীরা এসব বিষয়ে উদাসীন থাকেন, ফলে অফিস পলিটিকসে পিছিয়ে পড়েন। তবে কোনো কারণে দক্ষতা ও ধুরন্ধরপনা একসঙ্গে যুক্ত হলে তা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এ ধরনের কর্মীরা ‘ছায়া বস’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বসদের তত্ত্ব হলো ‘ভাগ করো, শাসন করো’। একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া, হেয় করা, চোখে চোখে রাখা তাঁদের বিশেষ কৌশল। তাঁরা মেন্টর নন, কোচ নন, গাইড নন। তাঁরা অফিসে বিভক্তির মূল কারক।
এমন কর্মপরিবেশে কর্মীরা তৎপর থাকেন বসের আনুগত্য লাভের আশায়। পরাধীন হওয়ার জন্য। কারণ, কর্মীরা জানেন, নির্ভেজাল আনুগত্য ছাড়া টিকে থাকা যাবে না।
ভাষাতাত্ত্বিক কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী একে ‘বরহকরণ প্রকল্প’ বলে অভিহিত করেছেন। অফিস পলিটিকসের ফাঁদে পড়ে অনেকে আজ দিশাহারা, মেরুদণ্ডহীন। অফিস পলিটিকস অনেকের মেরুদণ্ড নিয়ে যায়।
অফিস পলিটিকস অযোগ্যদের যোগ্য আর যোগ্যদের অযোগ্য করে তোলে।
অফিস পলিটিকসে থাকে দল, উপদল, ক্ষুদ্র দল, একক দল।
একসঙ্গে চা খান, লাঞ্চ করেন, অফিসে, জন্মদিন পালন করেন কিন্তু একে অন্যের প্রতি বিশেষ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নেই। সুযোগ পেলে দেখে নেন, সরিয়ে দেন। অস্বীকৃতি ও অসহযোগিতা অফিস পলিটিকসের আরেক দিক।
এখানে সব সাফল্য বসের বা সবার কিন্তু ভুল বা ব্যর্থতাগুলো কর্মীর একার। এখানে স্বার্থকে সবাই ভজে।
অফিস পলিটিকস নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া। কর্মীর সবকিছু শুষে নেয়। চাকরি হারানো ও রুটি-রুজির ভয় সার্বক্ষণিক তাঁকে তাড়া করে ফেরে। অফিস পলিটিকস ভয় উৎপাদন করে, জারি রাখে এবং ছড়িয়ে দেয়।
অফিস পলিটিকসের ছায়ার নিচে সবাই বসের অপ্রয়োজনীয় স্তুতি গাইতে ব্যস্ত থাকে। অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা করে শান্তি পায়, স্বস্তি খুঁজে।
অফিস স্পেসে পেশাদারি, পরিশীলিত ও উত্তমচর্চার আকাঙ্ক্ষা অধরা থেকে গেল! অফিস পলিটিকস নিয়ে নির্মোহ বোঝাপড়া জরুরি। যেহেতু চাকরি করতে হবে, সংসার চালাতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে। এখানে কৌশলী হয়ে বাঁচতে হবে। কান খাড়া রাখতে হবে। জীবন খচর করে কৌশলগুলো শিখতে হবে।
অফিস পলিটিকস কর্মীর মর্যাদাবোধ ভুলিয়ে দেয়, পরিচয়হীন করে তুলে, ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসার যোগ্য করে তোলে। অধস্তন সংস্কৃতির উৎপাদন করতে না পারলে অফিস পলিটিকস টিকিয়ে রাখা যায় না।
এর নিচে সবাই বনসাই। অফিস পলিটিকস কাঠের পুতুল বা অনুগামী শ্রেণি তৈরি করে।
এ পলিটিকসে কর্মীদের বড় অংশ কেন্দ্র থাকতে চান, ফাস্ট হতে চান। ফাস্ট হওয়ার বিড়ম্বনা বুঝতে চান না। ফাস্ট হতে গিয়ে তাঁরা রোলপ্লে করেন। বসের কাছে অন্যদের সম্পর্কে নানা কথা সরবরাহ করেন।
অবস্থানের কারণে অনুগত বাহিনীর কাছ তিনি থেকে তথ্য, অপতথ্য ও বাড়তি তথ্য পেয়ে থাকেন।
এ ধরনের বসেরা থাকেন তাৎক্ষণিকতার ভেতর এবং তাঁর সিদ্ধান্ত হয় তাৎক্ষণিকতার ভিত্তিতে। অবস্থানের কারণে বসদের গুরুত্বহীন ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত কর্মীদের কাছে যৌক্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
অফিস স্পেসে পেশাদারি, পরিশীলিত ও উত্তমচর্চার আকাঙ্ক্ষা অধরা থেকে গেল!
অফিস পলিটিকস নিয়ে নির্মোহ বোঝাপড়া জরুরি। যেহেতু চাকরি করতে হবে, সংসার চালাতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে।
এখানে কৌশলী হয়ে বাঁচতে হবে। কান খাড়া রাখতে হবে। জীবন খচর করে কৌশলগুলো শিখতে হবে।
খান মো. রবিউল আলম, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক