উদিত দুঃখের দেশে নাগরিক মর্যাদা ও গলায় জুতার মালা

আবুল হাসানের কবিতার মতো যেন ‘গলগণ্ডে ধুতরার বীজ’ নিয়ে শুয়ে ছিলেন তাঁরা, ‘যেন কারও আদি নেই। কারও অনাদি নেই।’ মানে সাতজন নৌশ্রমিক। চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীর ডুবোচরে সারবাহী জাহাজ থেকে তাঁদের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হলো। কে মারল, কেন মারল, রহস্যজনক এক ব্যাপার। যদিও একজনকে গ্রেপ্তার করার পর প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, বেতন–ভাতা ও ছুটি নিয়ে ক্ষিপ্ত থাকা সেই ব্যক্তি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এখন সেটি কতটা সত্য বা প্রকৃত ঘটনা কী, তা হয়তো জানা যাবে আরও পরে। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। সমাজ, মানুষ ও রাজনীতি এখনো যে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এর অবসান কোথায়? হেলাল হাফিজের মতো বলতে হয়—কথা ছিল একটি ‘বিপ্লব হলে’, আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা। কিন্তু হায়, বেদনার কবিতাই লিখে যেতে হচ্ছে আমাদের। যার শেষ লাইন কখন কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেটিও অজানা বলেই এখনো টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের লাইন ফুরোয় না। এখনো ভূমধ্যসাগরের তীরে আমাদের ভাইদের লাশ ভেসে আসে। এখনো রাজধানীর বুকে পার্কের গাছ কেটে সাফ করে ফেলে উন্নয়নের বুলডোজার। এখনো জুলাই অভ্যুত্থানের আহত কিশোর চিকিৎসার অবহেলায় মরে যায়। 

গণতন্ত্র, মানে ডেমোক্রেসির রূপ হয়ে গেছে এখন মবোক্রেসি। অথচ আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। গণ-অভ্যুত্থান যায়, গণ-অভ্যুত্থান আসে আর এসব যেন রূপকথার গল্পের লাইন হয়েই থাকে। কুমিল্লায় একজন অটোরিকশাচালককে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। কোথাও হলো মানববন্ধন।

আমার চোখে তখন ভেসে ওঠে অল্প বয়সের একটি ঘটনা। এক রিকশাচালককে মাত্র অল্প কয়েকটা টাকার জন্য জুতাপেটা করেছিল এক যাত্রী। এ ঘটনা এখনো ভুলতে পারি না। যদিও আমরা পরে জানতে পেরেছি, কুমিল্লার ওই রিকশাচালক ছিলেন প্রতারক চক্রের সদস্য। ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে চক্রের অন্য সদস্যরাই তাঁকে পিটিয়ে মেরেছেন। সেটিও কি কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য?

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে কৃষক লীগের একজন নেতাকে জুতার মালা পরিয়ে অপদস্থ করা হলো। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বিরুদ্ধে আবার হত্যা মামলাসহ অনেকগুলো মামলা আছে। তাঁর দল ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের দলের অন্য পক্ষের এবং বিরোধী দলের লোকেরা তাঁর অত্যাচারে এলাকায় থাকতে পারতেন না। পরে যদিও নিজেই দলের প্রতিপক্ষের কারণে এলাকাছাড়া হয়েছিলেন তিনি। এখন তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা বা অভিযোগ আছে, সেগুলো তো আইনি ব্যবস্থায় সুরাহার বিষয়। কিন্তু গলায় যে জুতার মালা পরানো হলো, এটি কোনো সভ্য আচরণ?

চোর চুরি করে ধরা পড়লে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া, জুতার মালা গলায় দিয়ে গ্রামে ঘোরানো—এসব একসময় ঢের দেখা যেত। বগুড়ায় তো তুফান সরকার মা-মেয়েকে ধর্ষণ ও নিপীড়ন করে উল্টো তাঁদের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছিলেন। 

একজন নাগরিক, হোক সে নিরপরাধ বা কোনো অন্যায়কারী বা নিজেই অন্যায়ের শিকার, তাকে যখন এভাবে জুতার মালা পরানো হয়, এটা তো চূড়ান্ত অমর্যাদাকর। নাগরিকের প্রতি এমন অমর্যাদা নিয়ে কীভাবে একটা রাষ্ট্র হয়! কুমিল্লায় এ ঘটনা যে বা যারাই ঘটিয়েছে, তাদের কয়েকজনকে ধরা হয়েছে দেখলাম, দোষী ব্যক্তিরা যেন শাস্তি থেকে পার না পায়।

গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) (এসি ল্যান্ড) সবার সামনে বাবার বয়সী এক ঠিকাদারকে থাপ্পড় মেরেছেন। সেখানে একটা সেতুর কাজে খাল থেকে মাটি তোলা নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ঠিকাদারকে থাপ্পড় মেরে বসেন তিনি। থাপ্পড় খেয়ে ঠিকাদার মাটিতে পড়ে যান। এ ঘটনায় স্থানীয় জনতা উত্তেজিত হলে তিনি তখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সে সময় অন্য সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিকসহ অর্ধশতাধিক লোক উপস্থিত ছিলেন।

ঠিকাদারের কাজের কোনো ভুল বা অন্যায় হলে বিধি মোতাবেক তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার এসি ল্যান্ডের আছে। কিন্তু কোনোভাবেই তাঁকে থাপ্পড় মারতে পারেন না। একজন সরকারি কর্মকর্তা সার্ভেন্ট এভাবে নাগরিকের গায়ে হাত তুলবেন, এটা তো কোনোভাবে মানা যায় না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমলাতন্ত্র নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও এমন ঘটনা আমাদের দেখতে হলো। 

ময়মনসিংহে গত জুন মাসে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় এক কিশোর ও আরও কয়েকজন মিলে। পুলিশ ও পরিবার বলছে, ওই কিশোরের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় কিশোরীটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে তিন মাস ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। চোখের এমন ক্ষতি করা হয়েছিল যে উন্নত চিকিৎসার জন্য তার কর্নিয়া খুলে রাখতে হয়েছিল। সেই চোখে আলো ফিরবে কি, চিরতরে কিশোরীর প্রাণটাই নিভে গেল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখাউড়ায় এক নারী কী এমন দোষ করেছিলেন যে তাঁকে হত্যা করতে হবে, শুধু তাই মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেহ পুড়িয়ে ফেলতে হবে? জীবিত মানুষেরই মর্যাদা নাই, সেখানে লাশের মর্যাদাই বা থাকবে কেন!

জানা যাচ্ছে, স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার বাসায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতেন এবং তাঁর ছেলেকে দেখাশোনা ও লালনপালনও করেছিলেন ওই নারী। সেই ছেলে বড় হলেও তাকে নানা কিছুতে শাসন করতেন তিনি। এর সূত্র ধরে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে হত্যা করল ওই তরুণ।

গণ-অভ্যুত্থান যায়, গণ-অভ্যুত্থান আসে, ফ্যাসিস্ট শাসকও পালিয়ে যায় আর আমরা ‘উদিত দুঃখের দেশের’ নাগরিকই থেকে যাই। কয়েক কোটি টাকা খরচে বিদেশি গায়কের গান শুনিয়েও কি সেই দুঃখ ভোলানো যায়? জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘চারিদিকে অন্ধকার বেড়ে ওঠে;/ ঘুমোবার ভান করে প’ড়ে আছে ঢের যাত্রী/ ভান ঢের ভালো হলে অঘোরে ঘুমোবে...’। আমরাই তো সেই ‘যাত্রী’, আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে, কে আছে ভাঙানোর? সংস্কার নাকি নির্বাচনের খেলায় আমরা ভুলে যাই, ‘রাজনীতি একটি কালো হরিণের নাম!’ 

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

[email protected]