প্রত্যাবাসন না আত্মীকরণ—কোন পথে রোহিঙ্গা সংকট?

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সর্ববৃহৎ ঢলটি বাংলাদেশে আসেছবি : রয়টার্স

রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য প্রায় পাঁচ দশকের একটি সমস্যা। সর্বশেষ বৃহৎ ঢলটিও আট বছর পেরিয়ে ইতিমধ্যে প্রলম্বিত শরণার্থী সংকটে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রবেশ করতে দেওয়া চরম ভুল হয়েছিল বলে মত দিচ্ছেন। তবে প্রতিবশেী দেশের সংঘাতে এ ধরনের শরণার্থী বা উদ্বাস্তু তৈরি হওয়া এবং তাদের আশ্রয় দেওয়া যেমন মানবিক, তেমনি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। জীবন রক্ষার জন্য রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক অন্য কোনো উপায় ছিল না, যদিও রোহিঙ্গা সমস্যাটি সমসাময়িক অন্যান্য শরণার্থী সমস্যা থেকে ভিন্ন।

ইউরোপে সিরীয় শরণার্থী, কেনিয়ায় সোমালি শরণার্থী, পাকিস্তানে আফগান শরণার্থী—তারা সবাই একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিল। অনেক শরণার্থী সমস্যা আবার প্রথমবারের মতো সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিক থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা ভিন্ন, যা একটি একপক্ষীয় নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে সৃষ্ট। তারা কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে পলায়নপর কোনো উদ্বাস্তু নয়। ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট, মিয়ানমার রাষ্ট্রটির কোনো সরকারই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব মেনে নেয়নি। তাই যেকোনো অজুহাতে তাদের বিতারণ ও নিধন করার সব পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করেছে।

এই পুরো প্রক্রিয়ায় ভারত, চীন ও রাশিয়া নীরব ভূমিকা পালন করেছে, অনেকাংশে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্মূলে উৎসাহিত করেছে। রাষ্ট্রগুলোর এ ধরনের ভূমিকার পেছনে অনেক কারণ ও স্বার্থ রয়েছে। শরণার্থী সমস্যার প্রভাব উৎস ও আশ্রয়দাতা উভয় দেশের জন্যই দীর্ঘস্থায়ী হয়। অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় অভিবাসন ও শরণার্থীস্রোতকে যেভাবে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাতে শরণার্থীদের মানবাধিকার বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে কেবল মৃত্যুর জন্যই দিন পার করে।

আন্তসীমান্ত সংঘাতের বড় একটি কারণ হয়ে দাড়াঁয় শরণার্থী। এই আশঙ্কা বাংলাদেশকেও উচ্চ নিরাপত্তাঝুঁকিতে ফেলেছে। সব দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ক্যাম্পের মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে। অন্যদিকে রোহিঙ্গারাও বুঝতে পারছে যে ক্যাম্পে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এই সমস্যার আশু কোনো সমাধান নেই।

এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ভূরাজনীতিতে দিন দিন পশ্চিমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচার করা এবং চীনের মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান—এই যুগপৎ চেষ্টা কোনো ফল দেবে না। সার্বিক সমীকরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধানে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে এ পর্যন্ত একাডেমি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবু আরও আলোচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে নতুন ঢলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম করে হলেও ডজনখানেক সন্ত্রাসী গ্রুপ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরকারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তবু প্রতিনিয়ত হত্যা, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসা, জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতা বেড়েই চলেছে।

বর্তমান বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের জন্য অপরিহার্য মানবিক সহায়তার জোগান নিশ্চিত করা প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ জন্য প্রতিবছর ন্যূনতম ৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু দীর্ঘায়িত শরণার্থী সমস্যার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দাতাসহায়তা হ্রাস পেতে থাকে। এই আট বছরে সহায়তার জোগান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা বিদ্যমান কাঠামোগত অন্যান্য সব সমস্যাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে। সিংহভাগ দায়িত্ব চলে আসতে পারে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রের ওপর। এ ছাড়া সর্বশেষ যে আন্তর্জাতিক শরণার্থীনীতি, সেখানে মানবিক সহায়তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে আত্মীকরণের প্রতি জোর দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে তা-ও সম্ভব নয়।

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, সরলভাবে বললে, বিপুল জনগোষ্ঠীর ছোট্ট একটি দেশে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী নিয়ে উন্নয়ন, শান্তি–শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ যত দিন পর্যন্ত এই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান না হবে, তত দিন বাংলাদেশের উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়া (গ্র্যাজুয়েশন) পিছিয়ে যাবে। অপর দিকে উন্নত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শরণার্থীনীতি প্রণয়ন এবং শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করার একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতাও চলে আসে।

একবিংশ শতাব্দীতে প্রত্যাবাসন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ সংঘাত (জাতিগত) এখন স্বাধীন নতুন কোনো রাষ্ট্রের জন্ম দিচ্ছে না। তৃতীয় দেশে স্থানান্তর সেটিও উদাহরণ দেওয়ার মতো নয়, তা ১ শতাংশের বেশি নয়। এ ছাড়া রিসেটেলমেন্ট উৎস দেশে থেকে যাওয়া বিপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে এবং তারাও বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোয় প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান শূন্য স্থানীয় আত্মীকরণ নীতি। এটি নীতি ও পুলিশিং দ্বারা আপাতভাবে সীমিত করা যায়। যেহেতু আন্তুর্জাতিক সম্প্রদায় ও ইউএনএইচসিআর অন্য দুটি সমাধান নিয়ে তেমন কিছু করতে পারে না, তারা মানবিক সহায়তার মাধ্যমে ক্যাম্পে স্থায়ীকরণে ও স্থানীয়করণে উদ্বুদ্ধ করে।

শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দাতা দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানাবিধ বিনিয়োগ সহায়তা করে থাকে। নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেও যদি আশ্রয়দাতা দেশের নীতি পরিবর্তন করতে না পারে, তখন মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বিভিন্ন অজুহাতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ সরকারও সেটি ভালোভাবে অনুধাবন করছে। তারই প্রতিফলন হলো প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর পরিকল্পনা। সব রোহিঙ্গার সেখানে স্থানান্তর সম্ভব না হলেও কক্সবাজারের জনগোষ্ঠী ও সম্পদের ওপর অভিঘাত হ্রাস পাবে। একই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরের মতো ভবিষ্যতে আরও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হতে পারে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে তা একই সঙ্গে দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো। একদিকে চীনের নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় সমাধান, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এক নৌকায় পা দিতে বাংলাদেশ অনেক চিন্তা করছে, কিন্তু দিন শেষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

এ ক্ষেত্রে জটিল ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে যেকোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বকে সংকটে নিপতিত করতে পারে, যেমন মানবিক করিডরের মতো কোনো পরিকল্পনা। তবে এটি স্পষ্ট আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীরা দোষী সাব্যস্ত হলেও রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

এ ছাড়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এই আদালতের আদেশ গ্রহণ না করলে তা বাস্তবায়ন করাও প্রায় অসম্ভব। এ আদালতের রায়ের মতো জাতিসংঘের অধীন রাখাইনে একটি নিরাপদ জোন করাও প্রায় একই আইনী (রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব) বাধায় সীমাবদ্ধ। মিয়ানমার না চাইলে জাতিসংঘের পক্ষেও সেখানে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ যে বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, তা হলো চীনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন।

এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে কি না, তা সব সময়ই বিবেচ্য। অর্থাৎ চীনমুখী নীতি বা চীনের প্রতি নির্ভরশীলতার নীতি বাংলাদেশ গ্রহণ করবে কি না, সে সিদ্ধান্ত খুব জটিল। এ ছাড়া চীনমুখী নীতি গ্রহণ করলেই শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ফিরতে পারবে কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং রাজনীতিতে বিশ্বস্ত বন্ধু বিষয়টি তেমন প্রযোজ্য নয়। একবিংশ শতাব্দীতে চীনের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিশ্লেষণে এই বিষয়ের সত্যতা লক্ষণীয়।

কেননা এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ভূরাজনীতিতে দিন দিন পশ্চিমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিচার করা এবং চীনের মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান—এই যুগপৎ চেষ্টা কোনো ফল দেবে না। সার্বিক সমীকরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধানে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।

অতীত ইতিহাস বিবেচনা করলে জাতিসংঘের ওপর নির্ভরশীলতা ব্যতীত বাংলাদেশের জন্য তেমন কার্যকর কোনো পথ খোলা নেই। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনর জরুরি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ধারাবাহিক সরকার একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বেশি সক্ষম। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো অনেক সমস্যা মোকাবিলাও সহজ হতে পারে। সর্বোপরি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচেষ্টা ও ঐকমত্য ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কোনোটিই অর্জন সম্ভব নয়।

  • সুদীপ রায় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, হাঙ্গেরির করভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়ে গবেষণা করেছেন