শিক্ষা উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা কে

উপদেষ্টা হিসেবে সি আর আবরারের শপথগ্রহণ, ৫ মার্চ ২০২৫ছবি: বিটিভির লাইভ থেকে নেওয়া

শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিক্রিয়ার কারণে হোক তিনি সেখান থেকে সরে এসেছেন বা আসতে বাধ্য হয়েছেন। ক্ষমতায় যাঁরা বসেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করেন, এমন নজির খুব কম। ভালো কাজ করতে তাঁদের বাধ্য করতে হয়।  

গত বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন ২২ জুলাই ও ২৪ জুলাইয়ের স্থগিত পরীক্ষা একই দিন সকাল ও বিকেলে হবে। অবশ্য ঠিক কোন দিন পরীক্ষাটি হবে, তখন জানাননি তিনি। বলেছেন, বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে। তাঁর এই ঘোষণা বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা ও টিভিতে প্রচারিত হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ফের শিক্ষার্থীর বিক্ষোভের আশঙ্কা দেখা দেয়।

এর কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকা আন্তশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হলো, ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা একই দিনে নেওয়া হচ্ছে না। স্থগিত পরীক্ষাগুলো আলাদা দিনে নেওয়ার জন্য নতুন সময়সূচিও ঘোষণা করে ওই কমিটি।  

পরিবর্তিত সময়সূচি অনুযায়ী, স্থগিত হওয়া ২২ জুলাইয়ের পরীক্ষা হবে আগামী ১৭ আগস্ট। আর ২৪ জুলাইয়ের পরীক্ষা হবে ১৯ আগস্ট।

হঠাৎ শিক্ষা উপদেষ্টার মাথায় একই দিন দুটি পরীক্ষার বিষয় ঢুকল কেন? এই নিয়ম তো অনেক আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রয়োজনে ছুটির দিনে  পরীক্ষা নেওয়া যেত। কিন্তু এক দিনে সকাল ও বিকেলে পরীক্ষার কথা ভাবা যায় না। শিক্ষা উপদেষ্টা কার পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা জানা দরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে। তারা একের পর এক সিদ্ধান্ত বদল করেছে। মহল বিশেষের চাপে পাঠ্যবই থেকে গ্রাফিতি প্রত্যাহার ও কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একের পর এক উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। কিছুদিন পরপর আমরা সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখি জাতীয় প্রেসক্লাব ও সচিবালয়ের সামনে। শাহবাগ ও  যমুনার আশপাশে। জনমনে ধারণা হয়েছে, রাস্তা বন্ধ না করা পর্যন্ত সরকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মানে না। আবার শিক্ষার্থীদের অন্যায্য দাবি বিনা বাধায় মেনে নেয়।

উদাহরণ হিসেবে গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা যায়। গণ-অভ্যুত্থানের কারণে আগস্টের আগে এইচএসসির সব পরীক্ষা হতে পারেনি। কয়েকটি পরীক্ষা বাকি ছিল। অভ্যুত্থানের পর একদল শিক্ষার্থী গিয়ে অটো পাস দাবি করলে সরকার তা মেনে নেয়। আগে যেসব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে, তার ভিত্তিতে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে তাঁরা শিক্ষার্থীদেরই বড় ক্ষতি করলেন, সেটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান নিশ্চয়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের ছিল। কিন্তু তাঁরা বিবেক দ্বারা চালিত না হয়ে মব ভায়োলেন্স দ্বারা চালিত হয়েছেন। সে সময় অবশ্য সি আর আবরার শিক্ষা উপদেষ্টা হননি।

তবে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরও শিক্ষা বিভাগে স্বস্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, এমন দাবি করা যাবে না। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ আছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করছেন। শিক্ষকেরা যাচ্ছেন না। উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মন্ত্রণালয়ও চুপচাপ।  

সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষকসহ এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছে, যার প্রায় সবাই শিশু। সরকারের পক্ষ থেকে পরদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়। প্রশ্ন ওঠে শোকাবহ এই পরিবেশে এইচএসসি পরীক্ষার আয়োজন কি যৌক্তিক? সংবাদমাধ্যমে যোগাযোগ করেও অনেক শিক্ষার্থী জানতে চেয়েছেন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে কি না। দিনভর এ নিয়ে আলোচনা চললেও পরীক্ষা স্থগিতের সরকারি সিদ্ধান্ত আসে রাত তিনটার দিকে।

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, নিয়োগকর্তা বললে তিনি পদত্যাগ করবেন। তাঁর নিয়োগকর্তা কে? তিনি যদি প্রধান উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর ও পুরো সরকারের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এই সরকারে এমন উপদেষ্টাও আছেন, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় নিষ্ক্রিয়। কোনো তৎপরতা নেই। তারপরও বহাল তবিয়তে আছেন।

তখন শিক্ষার্থীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। অনেকে সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারেন পরীক্ষা স্থগিতের খবর। স্বাভাবিকভাবে এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে সেই বিক্ষোভ ভাঙচুর ও সংঘর্ষে রূপ নেয়। বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জুবাইরকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানানো হলেও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যান। যদিও ছাত্রদের আন্দোলনে অ–ছাত্র ঢুকে যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রশ্ন ওঠে। নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মী সন্দেহে পুলিশ কয়েকজনকে আটকও করে। চট্টগ্রামে শিক্ষাবোর্ড অফিসের সামনেও একই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সেখানে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।  

বুধবার সাংবাদিকেরা পদত্যাগের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন,  ‘আমার (পদত্যাগ) চাওয়া হয়েছে। আমি নিজে থেকে করার কোনো অভিপ্রায় নেই। কারণ, এখানে আমার কাজের কোনো ব্যত্যয় হয়েছে বলে আমি মনে করি না। আপনাদের পরম্পরাটা জানালাম। আমার তো নিয়োগকর্তাও রয়েছেন। তাঁরা যদি মনে করেন, এখানে ব্যত্যয় ঘটেছিল, তো আমাকে যেতে বললে অবশ্যই চলে যাব। এখানে আক্ষেপ করার, নিজেকে জাস্টিফাই করার কোনো কিছু নেই।’
   
শিক্ষা উপদেষ্টার ভাষ্য অনুযায়ী যদি নিয়মের ব্যত্যয় না হয়ে থাকে, তাহলে কেন রাত তিনটায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেই ব্যাখ্যাও থাকা প্রয়োজন। বুধবার দুপুরে তাঁর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন ঘোষণা এল। এখানে কি সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট নয়?
দ্বিতীয় কথাটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, নিয়োগকর্তা বললে তিনি পদত্যাগ করবেন। তাঁর নিয়োগকর্তা কে? তিনি যদি প্রধান উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর ও পুরো সরকারের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এই সরকারে এমন উপদেষ্টাও আছেন, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় নিষ্ক্রিয়। কোনো তৎপরতা নেই। তারপরও বহাল তবিয়তে আছেন।

রাজনৈতিক সরকারে যেমনটি হয়ে থাকে, মন্ত্রী দক্ষ না হলে ঠেকা দেওয়ার জন্য একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারেও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার পাশাপাশি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োজিত আছেন। এটা কী ধরনের জবাবদিহি? আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মানুষ কথা বলতে পারত না। এই সরকারের আমলে কথা বলা যায়। কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যায় না।
আপনি যে প্রশ্নই করুন না কেন, নীতিনির্ধারকেরা বলবেন, সব ঠিক আছে। সব যে ঠিক নেই, অতি সাম্প্রতিক ঘটনাই তার প্রমাণ।

এই সরকার কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি, এসেছে চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজন তথা তারা যাদের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই জনগণই প্রকৃতপক্ষে সরকারের নিয়োগকর্তা হওয়ার কথা। সরকারের কাজকর্মের মূল লক্ষ্যও হওয়া উচিত তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ। বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটছে বলে মানুষ মনে করে।

আরও পড়ুন

এক দিন আগে দুই উপদেষ্টা দুর্ঘটনাকবলিত মাইলস্টোন স্কুলে গিয়ে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তা কোনোভাবে কাম্য ছিল না। তাঁরা নিশ্চয়ই সেখানকার শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মাত্রা আঁচ করতে পেরেছেন। এক দিন আগে যাঁরা এতজন সহপাঠীকে হারিয়েছেন, তাঁদের মনের ভাষাটাও সরকার তথা উপদেষ্টাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

সি আর আবরার যখন নিয়োগকর্তার কথা বলছিলেন, তখনই সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের একটি বিস্ফোরক মন্তব্য পড়লাম। প্রথম আলো আয়োজিত ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর হতে চলেছে। আজকে পাওনার হিসাবটা খুবই জরুরি।

এই পাওনার হিসাব নেওয়ার মালিক যারা, সেই জনগণই শিক্ষা উপদেষ্টা ও তাঁর সহযাত্রীদের নিয়োগকর্তা। অতএব, অন্য নিয়োগকর্তা না খোঁজাই ভালো।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি