শুল্কের ঝড়ের মুখে পোশাক খাত, আমাদের কী করণীয়

যুক্তরাষ্ট্রে একেকটি সাধারণ সুতি টি-শার্ট বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২ ডলারের কম দামে আমদানি করা হয়, অথচ সেই একই পণ্য দেশটির খুচরা বাজারে ১৪ থেকে ৩০ ডলারে বিক্রি হয়।ছবি: এএফপি

২০২৫ সালের ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এক অভূতপূর্ব সংকট সৃষ্টি করেছে।

আগামী ১ আগস্ট থেকে এই শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশ তার অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাজারে বিপুল প্রতিযোগিতাগত দুর্বলতার মুখে পড়বে। অথচ এই সংকট প্রতিরোধের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিত ও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ দৃশ্যমান ছিল না।

দেশের তৈরি পোশাকশিল্প—যা প্রায় ৪০ লাখ কর্মজীবী মানুষকে, বিশেষত নারী শ্রমিকদের জীবিকার উৎস হিসেবে কাজ দেয়—এখন এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক (যা আগের ১৫ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর শুল্ক বোঝায়) দেশটির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে তুলবে।

আরও পড়ুন

যদি এই শুল্ক শুধু বাংলাদেশের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে মার্কিন ক্রেতারা স্বাভাবিকভাবেই ভিয়েতনাম বা অন্যান্য বিকল্প উৎপাদনকারীর দিকে ঝুঁকবে।

কারণ, বাজারে মূল্যের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়। সুতরাং শুল্ক কমিয়ে প্রতিযোগীদের সমপর্যায়ে আনা এখন জরুরি রাষ্ট্রনৈতিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা—বাংলাদেশ যে পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তার মালিকানা থাকে মার্কিন কোম্পানির হাতেই।

যুক্তরাষ্ট্রে একেকটি সাধারণ সুতি টি-শার্ট বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২ ডলারের কম দামে আমদানি করা হয়, অথচ সেই একই পণ্য দেশটির খুচরা বাজারে ১৪ থেকে ৩০ ডলারে বিক্রি হয়।

অর্থাৎ প্রতিটি পণ্যে ১২ থেকে ২৮ ডলারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মূল্য সংযোজন থাকে, যা মার্কিন কর্মসংস্থান বজায় রাখতে সহায়তা করে। শুধু পোশাক খাতে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে এক মিলিয়নের বেশি মার্কিন নাগরিক কাজ করছেন।

এই বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করে যা দেশের স্পিনিং মিলগুলোর জন্য অপরিহার্য। এই তুলা পরে কাপড়ে রূপান্তরিত হয়ে রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ইউএসডিএর সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৮ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি উৎপাদনও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

এই পারস্পরিক নির্ভরতার বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

এই নতুন শুল্কনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন বাংলাদেশের নারী পোশাকশ্রমিকেরা। অর্ডার হ্রাস ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে লাখো নারী কর্মী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।

তাঁদের অধিকাংশই পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী, যাঁদের আয়ে নির্ভর করে শিশুর পুষ্টি, শিক্ষার খরচ এবং পরিবারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা।

আয় কমে গেলে সবার আগে খাদ্য খাতে কাটছাঁট শুরু হয়—এ কারণে অপুষ্টি, রক্তাল্পতা ও শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে; পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষমতাও কমে যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা ও জীবনমানে সরাসরি প্রভাব ফেলে।

আরও পড়ুন

সরকারের ব্যর্থতা এখানে দ্ব্যর্থহীন। ভিয়েতনামের মতো দেশে যেখানে আগেভাগেই কৌশলগত কূটনীতি এবং ব্যবসায়িক অংশীদারত্বের মাধ্যমে শুল্কহ্রাস নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে এই কৌশলগত দূরদর্শিতা ছিল অনুপস্থিত।

সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে পোশাক খাতের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত না করাও ছিল একটি বড় ভুল। আজ যখন পরিস্থিতি চরমে, তখন সরকারের অস্থায়ী প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে শেষ মুহূর্তে আলোচনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

এখনো অবশ্য সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। আগস্টের আগে জরুরি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক সমঝোতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে।

একই সঙ্গে দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন—যেমন খাদ্যে ভর্তুকি, নগদ সহায়তা এবং স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও আঞ্চলিক বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে নতুন বাজার তৈরি ও বহুমুখীকরণে অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এ সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি মানবিক সংকটও বটে। সরকারের দায়িত্ব এখন এই সংকট থেকে জনগণকে রক্ষা করা—তা না হলে দেশের রপ্তানি খাত ও মানুষের জীবন-জীবিকা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।

সঠিক সিদ্ধান্ত, দৃঢ় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং শ্রমিকদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণই পারে এই সংকট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে। সময় এখনই।

  • জিয়াউদ্দিন হায়দার বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক উর্ধতন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ