আত্মহত্যা দেশ-কাল-বয়স-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-পাত্রনির্বিশেষে ঘটে থাকে। রোমিও-জুলিয়েটের মতো কিশোর বা কৈশোরোত্তীর্ণরা প্রেমে ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যায় শান্তি খুঁজে পেতে চায়। বয়সের অপরিপক্বতা ও অপ্রতিরোধ্য আবেগ এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী। ব্যর্থতা, প্রতিহিংসা, অভাব, ঋণগ্রস্ততা, প্রেম, সম্পর্ক, নিপীড়ন, যৌতুক, হয়রানি, একাকিত্ব, অভিমান, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা, পরিবারে সদস্য ও বাইরের লোকজনের সঙ্গে ‘জেনারেশন গ্যাপ’, বুলিং, সাইবার বুলিং, মাদকাসক্তি ইত্যাদি সব বয়স ও পেশার মানুষের হতাশা ও আত্মহত্যার কারণ।
কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের আত্মহত্যার কারণ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা, গবেষণা, লেখালেখি চলতেই থাকে। সব ধর্মেই ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’–জাতীয় বাণী রয়েছে এবং যারা আত্মহত্যা করে, তারা যে তা জানে না তা নয়; কিন্তু আত্মহত্যা করার সময় কোনো ধর্মবাণী তাদের নিরস্ত্র করতে পারে না।
‘বার্কিং ডগ সেলডম বাইটস’ প্রবাদটা জানা দুই বন্ধুর প্রথম জন বলছে, ‘দোস্ত, কুকুরটা খুব ঘেউ ঘেউ করছে, কাছে যাস না কামড়ে দিতে পারে।’ দ্বিতীয় বন্ধু বলছে, ‘আরে জানিস না, যে কুকুর বেশি ঘেউ ঘেউ করে, সে কামড়ায় না?’ প্রথম বন্ধু বলে, ‘সে না হয় আমরা জানি, কিন্তু কুকুরটা কি জানে?’ তাহলে আত্মহত্যার কি কোনো সমাধান নেই? এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বিশ্লেষণ, জরিপ, গবেষণা, প্রতিবেদনের তো কোনো শেষ নেই। এ নিয়ে লিখতে গেলে তো মহাকাব্য হয়ে যাবে; বরং একটা বিশেষ শ্রেণির আত্মহত্যা ও তার প্রতিকারের বিষয়ে কিছু বলা যেতে পারে।
প্রতিবছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল করতে না পারা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
২০ জুলাই প্রথম আলো পত্রিকায় ‘পরীক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থামেনি’ শিরোনামে গওহার নঈম ওয়ারার লেখা থেকে ১০ জুলাই মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ১২ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৬ জনের আত্মহত্যার খবর জানা গেল।
ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টে জানা যায়, ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছে ৫৩২ শিক্ষার্থী। স্কুল ও সমমান পর্যায়ে আত্মহত্যা করেছে ৩৪০ জন শিক্ষার্থী। দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মাধ্যমিক ও সমমান পর্যায়ের মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। এর মধ্যে পাস করতে পারেনি ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৪ জন। ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করতে পারেননি। আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫১৩ জন আত্মহত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৩৬৭ জন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী।
এ পর্যায়ে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অসীম প্রত্যাশা মৃত্যুর জন্য দায়ী করা যায়। অভিভাবক সন্তানদের ঘাড়ে–পিঠে বই এবং একই সঙ্গে প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেন। ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’। সংগীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের সেই গান মনে পড়ে বারবার, ‘ডাকছে আকাশ ডাকছে বাতাস, ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস, ও ছেলেরা খেলা ফেলে শুধুই কেন পড়তে যাস?’ ওরা তিনবেলা পিঠে ব্যাগ নিয়ে জুলজুল করে মাঠের দিকে (মাঠ তো গায়েব, বাসার সামনে চিলতে কংক্রিটের রাস্তা) তাকাতে তাকাতে স্কুল ও কোচিংয়ে যায়।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে ‘ব্যর্থতা সফলতার ভিত্তিপ্রস্তর’ বা ‘আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়’ কিংবা ‘সফলতার চেয়ে মনুষ্যত্ব বড়’, এ ধরনের রচনায় আত্মহত্যায় উৎসাহিত না হওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা রাখতে হবে। সেখানে ব্যর্থ মানুষেরা কীভাবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তার গল্প থাকতে হবে। যাতে ছোট থেকেই আত্মহত্যা কোনো কাজের কাজ নয় জেনে তারা বেড়ে ওঠে। অভিভাবকদের নিয়ে এ বিষয়ে শিক্ষকেরা নিয়মিত মতবিনিময় করবেন।
কোনো কোনো অতি সংস্কৃতমনা অভিভাবক ওরই মধ্যে সন্তানের সুকুমার প্রবৃত্তি বিকাশের কথা ভেবে কোচিং শেষে গান-নাচ-বাজনা-ছবি আঁকা শেখাতে নিয়ে যান। কিন্তু বাইরে দৌড়ঝাঁপ-খেলাধুলা? ‘না বাবা, সবার সঙ্গে মিশতে দিলে বাচ্চা তার গোল্লায় যাবে না? বরং যেটুকু সময় হাতে পায়, মোবাইলে একটু গেম খেলুক।’ তারপর সারা দিনের পাঠ শেষ করে রাতে বসে হোমওয়ার্ক করতে করতে তারা ঘুমে ঢুলতে থাকে। আর সচেতন অভিভাবকের সাবধানবাণী ট্রমার মতো কানে বাজে, ‘এবার ক্লাসে ফার্স্ট না হতে পারলে আমি কিন্তু মুখ দেখাতে পারব না।’ এইভাবেই কেটে যায় ওদের শৈশব-কৈশোর।
পরিবার ছোট হয়ে আসছে। একটি বা দুটির ওপর সন্তান নিতে পারছেন না মা-বাবারা নাগরিক জীবনের নানা বাধ্যবাধকতায়। গ্রামীণ সমাজেও জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জন্মহার কমছে। একজন বা দুজন সন্তানের জন্য পিতা–মাতা সঞ্চয়ের প্রায় সবটুকুই বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেন। তাই তাঁদের প্রত্যাশাও হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। তাঁরা বোঝেন না, সবাই তো সমান মেধার নয়, সবাই তো সমান মনোযোগী নয় বা সমান সুযোগের অধিকারীও নয়।
সন্তানেরা যখন প্রত্যাশিত ফল উপহার দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের ওপর নেমে আসে গঞ্জনার অবিরাম বর্ষণ। পরিবার, সমাজ, বন্ধুবান্ধব—এমনকি শিক্ষকেরা পর্যন্ত তাদের অপমান করতে পিছপা হন না। আর ক্রমাগত তুলনা চলে, ‘সে পারে তুমি পারো না কেন?’ বলতে থাকেন, ‘যখন যা চাও তা-ই দেওয়া হয়, আর আমরা যা চাই তা দিতে পারো না কেন?’ এই যে অন্যের সঙ্গে তুলনা ও অনায়াস প্রাচুর্য—দুটিই সন্তানদের জন্য ভয়াবহ।
শিক্ষার্থী নিজেকেও যখন অবাঞ্ছিত ভাবতে থাকে, তখন সে আত্মহত্যার পথ অবলম্বন করে। অভিভাবকেরা পৃথিবীর কোনো কিছুর মূল্যেই তাঁদের সন্তানদের আর ফিরে পান না।
আত্মহত্যাও যেমন কোনো সমাধান নয়, তেমনি ব্যর্থতাও জীবনের শেষ কথা নয়। ছোটবেলায় রবার্ট ব্রুসের কাহিনি আমরা পড়েছি। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস বেশ কয়েকবার যুদ্ধে পরাজয়ের পর হতাশ হয়ে একদিন এক গুহায় দেখতে পান, একটা মাকড়সা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর সাতবারের অবিরাম চেষ্টায় জাল বুনতে সফল হয়। তিনি বুঝলেন, লেগে থাকা বা অধ্যবসায়ই হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি। ‘ব্যর্থতা সফলতার পিলারস্বরূপ’, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ ইত্যাদি প্রবাদ জানা থাকলেও সেগুলো শুধু ভাবসম্প্রসারণের বিষয় হিসেবে দেখা হয় বলে তা থেকে প্রকৃত শিক্ষালাভ হয় না।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে ‘ব্যর্থতা সফলতার ভিত্তিপ্রস্তর’ বা ‘আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়’ কিংবা ‘সফলতার চেয়ে মনুষ্যত্ব বড়’, এ ধরনের রচনায় আত্মহত্যায় উৎসাহিত না হওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা রাখতে হবে। সেখানে ব্যর্থ মানুষেরা কীভাবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তার গল্প থাকতে হবে। যাতে ছোট থেকেই আত্মহত্যা কোনো কাজের কাজ নয় জেনে তারা বেড়ে ওঠে। অভিভাবকদের নিয়ে এ বিষয়ে শিক্ষকেরা নিয়মিত মতবিনিময় করবেন।
বিদেশে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনেকে আশানুরূপ ফল করতে না পেরে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান, কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ দেশে ফিরে যান—এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু সেখানে এ বিষয়ে যেটা খুবই জনপ্রিয় ও কার্যকর তা হলো, কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হওয়া। ওসব দেশে কাউন্সেলিং শেষে অনেকেই হতাশামুক্ত জীবনে ফিরে আসেন। আমাদের দেশেও কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি অভিভাবক ও শিক্ষকদের জানতে হবে। শুধু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাউন্সেলর থাকলে চলবে না, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর রাখার ব্যবস্থা করা উত্তম।
বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘জীবনে ব্যর্থতার দরকার আছে’ শীর্ষক আত্মবয়ানে ইউনাইটেড ইউনিভার্সাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ অভাব–অনটনের মধ্যে বড় হয়ে মাধ্যমিকে ভালো ফল করার পরও উচ্চমাধ্যমিকে দুই–দুইবার অকৃতকার্য হন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। অনেক প্রতিকূলতা ও সংগ্রামমুখর জীবন বেছে নিয়ে তিনি নিজের টিউশনির পয়সায় অবর্ণনীয় সময়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করেন। তৃতীয়বার তিনি বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স করার পর তিনি নিজের টিউশনির টাকায় লন্ডন থেকে এমবিএ করে আসেন। অকৃতকার্যতা ও লাঞ্ছনায় জর্জরিত হয়ে তিনি একবারও আত্মহত্যার কথা ভাবেননি। তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সফলতার গল্প পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া শিক্ষার্থীরা জীবনে নতুন দিকনির্দেশনা পাবে বলে বিশ্বাস। অধ্যবসায়, অনুশীলন ও অনুপ্রেরণা থাকলে কারও হেরে যাওয়ার কথা নয়।
উম্মে মুসলিমা কথাসাহিত্যিক