সালাম তোমাকে, সারাহ ইসলাম

সারাহ ইসলাম

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যের বয়স হয়তো তখন ১২ কি ১৪। কিশোর আলোর পাঠকদের মাসিক সভা হচ্ছে কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে, প্রথম আলোর সেমিনার রুমে। সভা শেষে সারাহর মা আমাকে আলাদা করে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘আমি চাই, আমার মেয়েটা কিশোর আলোর দলে নিয়মিত আসুক। তাহলে ও ভালো থাকবে। ও হাসিখুশি থাকবে। আপনারা ওকে নিন।’ আমি সারাহর মাকে আশ্বস্ত করেছিলাম। ও নিয়মিত কিশোর আলোর সব অনুষ্ঠানে আসত। কিশোর আলো প্রতি মাসে বেরোনোর পর আমরা কিশোর-পাঠকদের নিয়ে আলোচনা সভা করতাম। সারাহ এই সভায় আসত। স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। এর বাইরে আমরা টের পাচ্ছিলাম, সারাহ একজন শিল্পী। ও ছবি আঁকতে ভালোবাসে। খুব সুন্দর কার্টুন-কমিক আঁকতে পারে। আমার একটা প্রতিকৃতিও সে এঁকে নিয়ে এসেছিল।

করোনার সময় আমাদের সব জমায়েত বন্ধ হয়ে গেল। সারাহর সঙ্গেও এরপর কমই দেখা হয়েছে। এর মধ্যে সারাহ অগ্রণী স্কুল পেরিয়ে হলিক্রস কলেজে গেছে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ইউডাতে ক্লাসও শুরু করেছে। সারাহ তবু কিশোর আলোতে আসত। আমার সঙ্গে ওর শেষ দেখা হয়েছে গত বছরের মার্চে। আমার জন্মদিনে ও আমাদের অফিসে এসেছিল। কিশোর আলোর দপ্তর প্রগতি ভবনের সপ্তম তলায়। এই তলায় অন্য আলো, প্রথমা, প্রথম আলোর সম্পাদকীয়, বিজ্ঞানচিন্তা, পড়াশোনা। এসব বিভাগের সব কর্মীই সারাহকে খুব পছন্দ করতেন। হালকা পায়ে একটা ভীরু প্রজাপতির মতো ছিল সারাহর চলাফেরা। মুখে ছিল একটা বিষাদমাখা হাসি। হাসিটা সব সময়ই থাকত।

সারাহর কিডনি দিয়ে দুজন মানুষ এখন কিডনি রোগ থেকে সেরে উঠছেন। সারাহর কর্নিয়া দিয়ে দুজন মানুষ দেখতে শুরু করেছেন। এদের একজন ছিলেন জন্মান্ধ। বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথম অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের নাম চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর এ ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরি হবে। অনেক মানুষ নতুন জীবন পাবে।’

মার্চের পর যে সারাহ আর আসেনি আমাদের অফিসে, তার কারণ, এখন বুঝতে পারছি, ওর অসুখটা খুব বেড়ে গিয়েছিল। সারাহর মা শবনম সুলতানার সঙ্গে ২১ জানুয়ারি ২০২৩-এ দেখা করতে গিয়েছিলাম। সারাহর কবর জিয়ারতও করে এসেছি ওর মা-খালাদের সঙ্গে।

নর্থরোডে সারাহদের বাড়িতে সারাহর ঘরটা যে কী সুন্দর! ছোট্ট বিছানা। দেয়ালে ছবি ঝুলছে। একটা ছোট্ট অ্যাকুয়ারিয়ামে ছোট ছোট মাছ অক্লান্ত সাঁতার কাটছে। গুছিয়ে রাখা অনেক বই। নানা ধরনের গল্পের বই। ছবি আঁকার অ্যালবাম। আর ছবি আঁকার সরঞ্জাম। রং, তুলি। প্যালেটে এখন রং ভরে রাখা। আর দেয়ালজোড়া সারাহর নানা রকমের ছবি। সারাহর মা বলেন, জন্ম থেকেই সারাহ একটা অসুখ বহন করছিল। ওর ভীষণ মাথাব্যথা করত। সেই অসহ্য ব্যথা নিয়েই সারাহ হাসত, ছবি আঁকত, স্কুলে যেত, ভালো রেজাল্ট করত। ২০২২ সালের মার্চ থেকে ওর অসুখটা বেড়ে যায়। ওকে হাসপাতালে যেতে হয় লাগাতার। তারপর তার ব্রেনে সার্জারি করার সিদ্ধান্ত এল।

আরও পড়ুন

কুড়ি বছরের আমাদের ছোট্ট মেয়ে সারাহ কী সাহসিকতার সঙ্গেই না এই ব্যথাদীর্ণ সময়কে মোকাবিলা করছিল। ওর ফেসবুকের স্ট্যাটাসগুলোয় সবকিছু নিয়েই প্রসন্ন রসিকতা। হাসপাতালে চিকিৎসকেরা বিরল রোগের রোগী পেয়ে বারবার আসছেন, ওকে স্টাডি করে শিখছেন। ৯ জানুয়ারি ২০২৩ শেষ স্ট্যাটাসে সারাহ লিখেছিল, ‘জন্ম থেকেই আমার একটা বিরল কন্ডিশন ছিল। ভেতরের রক্তক্ষরণ গোপন করে আমি সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতাম।... আমি স্বাভাবিক স্কুলে গেছি, কলেজে গেছি, সবকিছুই আজ মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। অনেক বছর পর স্বীকার করতে হচ্ছে, অন্যদের মতো আমি নই। নানু নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে গর্বিত হবেন।’

সারাহরা নানির সঙ্গেই থাকত। ওর নানা সানাউল্লাহ নূরী কবি ছিলেন। সারাহ, নানি, মা, সারাহর ছোট ভাই আদিত্য—এই ছিল ওদের নিরিবিলি পরিবার। দু বছর আগে নানি মারা যান।

১ জানুয়ারি সারা ফেসবুকে লিখেছে, ‘মানুষ জানতে চায় আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে। আমি: এই তো, আমার মাথা কাটবে।’ভেতরে বেদনা থাকলে হাসা আর হাসানো ছাড়া আমরা আর কী–ই বা করতে পারি!

আমাদের এই ছোট্ট মেয়ের এত এত বেদনা ছিল। লঘুতা দিয়ে তা সে আড়াল করে রেখেছিল। তারপর এল সেই সময়। ১১ জানুয়ারি তাকে সার্জারির জন্য নেওয়া হলো। তার আগে সে মাকে বলে রেখেছিল, তার শরীর যেন দান করে দেওয়া হয়। বলেছিল, ‘আইনস্টাইনের ব্রেন নিয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে, আমার ব্রেনটাও দান করে দিয়ো। চিকিৎসকেরা গবেষণা করবেন।’

সারাহর ‘ব্রেন ডেথ’ পরিস্থিতি। যন্ত্র দিয়ে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস চলছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকেরা সারাহর মাকে বুঝিয়ে বললেন পরিস্থিতি। শবনম সুলতানা একমুহূর্ত দেরি করেননি। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা ওর কিডনি দুটো নিতে পারেন। শুধু একটাই অনুরোধ, অকারণ যেন সময় নষ্ট না হয়।’ এর মধ্যে শবনম সুলতানার এক বোন বললেন, ‘তাহলে তো তুই ওর কর্নিয়া দুটোও দান করে দিতে পারিস।’ সন্ধানীকে খবর দেওয়া হলো। ১৮ জানুয়ারি রাতে নেওয়া হলো কর্নিয়া। ১৯ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে নেওয়া হলো ওর কিডনি দুটো। তারপর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হলে স্বর্গের শিশুটি স্বর্গে চলে গেল। ওর দুচোখ থেকে অশ্রু হয়ে ঝরছিল রক্ত। কিন্তু এক প্রশান্ত স্নিগ্ধ হাসিতে ওর মুখটা ভরে উঠেছিল আর ভরে তুলেছিল চারপাশ।

আরও পড়ুন

সারাহর কিডনি দিয়ে দুজন মানুষ এখন কিডনি রোগ থেকে সেরে উঠছেন। সারাহর কর্নিয়া দিয়ে দুজন মানুষ দেখতে শুরু করেছেন। এদের একজন ছিলেন জন্মান্ধ। বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথম অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের নাম চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর এ ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরি হবে। অনেক মানুষ নতুন জীবন পাবে।’ সারাহর নামে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছু করা হবে, ওর নামে হবে কর্নার, হবে বিভাগ, প্রবর্তন করা হবে পুরস্কার। জাতীয় পর্যায়ে ওকে পুরস্কৃত করার প্রস্তাবও দেবে তারা।

২২ এপ্রিল ২০২২ সারাহর মা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সেই অকুতোভয় মেয়েটি  যে কিনা বরাবরই রক্তশূন্যতায় ভোগে... সে কিনা কারও জরুরি রক্তদানের প্রয়োজনে ছুটে চলে যেত রক্তের সন্ধানে.. ক্লাসে কারও বমি হচ্ছে, সবার আগে সে–ই ছোটে, স্কুলের টয়লেটে পড়ে থাকা আরেকটি মেয়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে সে–ই প্রতিবাদ করে সবার আগে..বেশ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সড়ক আন্দোলনের সময়ও সে রাস্তায়। এ দেশে নারীরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কেন নিরাপদে পথ চলতে পারবে না! সেই প্রতিবাদে মশাল জ্বালিয়ে  গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সড়কে সবার সাথে ও তো থাকবেই। এ রকম আরও কত প্রতিবাদ, কত আন্দোলন!! প্রতিবাদী ভাষা ওর ফেসবুক পেজে... মেয়েটি  এখন   লড়ছে ওর জীবন–মরণ যুদ্ধে!!  পাশে আছেন ওর একান্ত আপনজনেরা.. বন্ধুরা...। সত্যিই..ওদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আর সবার ওপরে আছেন  মহান সৃষ্টিকর্তা!! আমিন।’

আরও পড়ুন

১৭ জানুয়ারি ২০২৩ সারাহর মা ফেসবুকে লিখলেন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। ১৯ জানুয়ারি তাঁকে লিখতে হলো, ‘আমার সোনার ময়না পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়েই গেল!’

সারাহ আর নেই, কতবার চোখ মুছেছি। কিন্তু সারা আমাদের শোকগ্রস্ত হতে দিচ্ছে না, গর্বিত করে রেখেছে। আমাদের মাথা উঁচু হয়ে গেছে, আমাদের বুক প্রসারিত হয়ে গেছে। সারাহ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি, যে ব্রেন ডেথ থেকে মৃত্যুর আগে নিজের অঙ্গ দান করে চারটা পরিবারে হাসি ফিরিয়ে দিল। সারাহ, তোমাকে স্যালুট জানাই, মা। সারাহর মাকে জানাই অন্তর নিংড়ানো শ্রদ্ধা। সারাহর মা বলেছেন, সারাহ ছিল পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিল্পী। শিল্পীরা তো মানবদরদিই হয়। এই কথা যেন সব শিল্পী মনে রাখেন। আর শবনম সুলতানা বলেছেন, ব্রেন ডেথ পরিস্থিতি যদি কারও স্বজনের জীবনে আসে, তাহলে তাঁরা যেন তাঁদের অঙ্গ দান করে দেন। তাহলে অনেকের কষ্টই দূর হবে।

কবি লিখেছেন, ‘ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে, সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।’ আর আমরা বলব, ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে, সে–ই আমাদের সবাইকে, মানবতাকে, মানবিকতাকে বড় করে তুলেছে। অনেক বড়। সালাম, তোমায়, সারা ইসলাম ঐশ্বর্য।’

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক