২০০ শিক্ষার্থী আহত হলেন, কয়েকজনকে আইসিইউতে ভর্তি হতে হলো, চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনজন শিক্ষার্থীকে ঢাকায় আসতে হলো। স্থানীয় মানুষের অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো, মোটরসাইকেলসহ যানবাহন ভাঙচুর হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকল।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, বগুড়া থেকে এক শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলেন। বাসে সিট নিয়ে তাঁর সুপারভাইজার ও চালকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এ ধরনের কথা-কাটাকাটি কিংবা বচসা গণপরিবহনের ক্ষেত্রে নিত্যদিনের ঘটনা। তাৎক্ষণিকভাবেই সেটা মিটিয়ে ফেলা যেত। কিন্তু কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি হয়নি। ওই যে সবার মাঝেই দেখিয়ে দেওয়া কিংবা শিক্ষা দেওয়ার কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে বাসটি একসময় এসে থামে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন শিক্ষার্থী বাসটিতে উঠে চালককে টেনেহিঁচড়ে নামাচ্ছেন। পরে কয়েকজন বাসে উঠে সহকারীকে খুঁজছেন। ভয়ার্ত এক নারী যাত্রীর কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে।

এরপরের ঘটনা শুধু শিক্ষার্থী আর বাসের চালক ও সহকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিনোদপুর বাজারের স্থানীয় মানুষের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের থামাতে শুরুতেই কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ছাত্রলীগ যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি ব্যাপকতায় রূপ নেয়। আর পুলিশ বরাবরের মতো ‘রোগী মরার পর’ উপস্থিত হয়েছে।

না শিক্ষার্থী, না বাসচালক ও সুপারভাইজার, না বিনোদপুরের বাসিন্দা, না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, না পুলিশ—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো পক্ষই যৌক্তিক অবস্থান নেয়নি। পরিচয় দেয়নি ন্যূনতম সহিষ্ণুতার। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের কেন বিরোধ হবে? রাজশাহীর পুরো অর্থনীতি কিংবা শহরটির সংস্কৃতির সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওতপ্রোত সম্পর্ক।

এ ধরনের ঘটনা যে পেটানো ছাড়া, কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা ছররা বুলেট না ছুড়ে সমাধান করা যায়, সে দীক্ষাটাই পুলিশের নেই। আর কোনো এক কারণে এ ধরনের সংঘাতে দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসাকারী হিসেবে না দাঁড়িয়ে পুলিশ সাধারণত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এ কারণে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় মানুষের সংঘর্ষ একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও পুলিশ-স্থানীয় সংঘর্ষে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের এভাবে চড়াও হওয়ার মনস্তত্ত্বটা আসলে কী? এর পেছনেও ক্ষমতাচর্চা কিংবা দেখিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কি জড়িত নয়?

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের বর্ণনায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে সেখানে পুলিশের একপেশে ও  বাড়াবাড়ির বিষয়টি স্পষ্ট: অনেকে শিক্ষার্থীর বারান্দা ও মেঝেতে ঠাঁই হয়েছে। কারও মাথা ইটের আঘাতে থেঁতলে গেছে, কারও শরীরে রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাসের সেলের ক্ষত। একজন রক্তাক্ত টি-শার্ট দেখিয়ে বললেন, পুলিশের রাবার বুলেটে এই অবস্থা হয়েছে। একদিকে পুলিশের মার, অন্যদিকে স্থানীয়দের। দুই পক্ষ মিলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়েছে। হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগের আঘাত চোখে, মাথায়, হাতে, কারও কারও সারা শরীরে। (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: পুলিশের বাড়াবাড়ি, কর্তৃপক্ষ কি ঘুমিয়ে ছিল? ১৩ মার্চ, ২০২৩)

না শিক্ষার্থী, না বাসচালক ও সুপারভাইজার, না বিনোদপুরের বাসিন্দা, না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, না পুলিশ—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো পক্ষই যৌক্তিক অবস্থান নেয়নি। পরিচয় দেয়নি ন্যূনতম সহিষ্ণুতার। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের কেন বিরোধ হবে? রাজশাহীর পুরো অর্থনীতি কিংবা শহরটির সংস্কৃতির সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওতপ্রোত সম্পর্ক।

যে বিনোদপুরের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে গেল, সেখানকার অর্থনীতি পুরোটাই সচল থাকে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। একসঙ্গে থাকতে গেলে মনোমালিন্য, কথা–কাটাকাটি খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু সেটা কেন এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে গড়াবে?

সমমর্মিতা, দয়া, মমত্ব, সহিষ্ণুতা—এ ধরনের ইতিবাচক আবেগের চর্চার বড় কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকবদল ঘটেছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনতার যৌথতার মধ্য দিয়েই। কোন রাজনীতির চর্চা সেই সেতুবন্ধকে ভেঙে দিয়ে পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, সে প্রশ্ন সামনে আনা জরুরি।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী