মুখে আর কত চুনকালি পড়লে...

ক্যাম্পাসে ধর্ষণের সঙ্গে কেন বারবার ছাত্রলীগের নাম আসে?

ছাত্রলীগ খবরের শিরোনাম হরহামেশাই হয়, আবারও হলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খবরের শিরোনামে জায়গা পেল। খবরে এসেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছেন ছাত্রলীগ নেতা ও তাঁর বহিরাগত বন্ধু । ঘটনায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী নারী।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে। অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে। পুলিশ ও র‌্যাব প্রধান দুই অভিযুক্ত তাদেরকে সহযোগিতার অভিযোগে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণে ছাত্রলীগের সদস্যদের যুক্ত থাকা এবং ধর্ষণবিরোধী ব্যাপক আন্দোলনও এইবার প্রথম ঘটল না।

এর আগে এই ধরনের ঘটনা নব্বইয়ের দশকে ঘটেছিল, আমাদের সবার মুখে চুনকালি পড়েছিল, ছাত্রলীগের একজন নেতার সম্পর্কে এই রকমের অভিযোগ ছড়িয়েছিল যে, তিনি ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছেন এবং সে উপলক্ষ উদ্‌যাপন করেছেন। প্রবল আন্দোলনের মুখে তিনি বিদেশ চলে যান।

আরও পড়ুন

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজের সামনে থেকে এক তরুণীকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন। ওই তরুণী তাঁর স্বামীর সঙ্গে একটি গাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্বামীকে গাড়িতে আটকে রাখা হয়। পরে কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। মেয়েটির আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকেরা এগিয়ে আসে। পরে মামলা হয়। গ্রেপ্তার হয়। এই মামলার রায় এখনো হয়নি। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪):

‘এই ঘটনায় এমসি কলেজের আটজন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগ গঠন করে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনার পর ডিএনএ পরীক্ষা করে চার আসামির সঙ্গে ডিএনএ ম্যাচিং পাওয়া যায়। সে সময় চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত জেলা মনিটরিং কমিটি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ না থাকায় ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী হাইকোর্টে রিট করেন। পরে ওই বছরেরই ১৫ই ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বদলি করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু মামলা স্থানান্তর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনো গেজেট জারি করা হয়নি।’

কিন্তু বারবার করে ছাত্রলীগের নাম এই সব অপকর্মে কেন আসে? চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রবাজি, দখল, টেন্ডারে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নাম সব আমলেই কেন আসে?

প্রশ্ন হচ্ছে, বারবার ছাত্রলীগের নামই কেন আসে? প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষণ মামলার বিচারের রায় কেন আসে না বা আসতে এত দেরি হয় কেন?

নিউইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সেস জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০০০ সংখ্যায় প্রকাশিত রান্ডি থর্নহিল এবং ক্রেইগ টি পালমারের লেখা ‘মানুষ কেন ধর্ষণ করে’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পুরুষ কেন ধর্ষণ করে? এটা একটা ভয়ংকর অপরাধ। এবং এটা হলো একটা সেই অসুস্থ সমাজের লক্ষণ, যে সমাজে পুরুষেরা নারীকে ভয় পায় এবং অসম্মান করে। ১৯৭৫ সালে নারীবাদী লেখক সুসান ব্রাউনমিলার বলেন, ধর্ষণের সঙ্গে যৌনলালসার সম্পর্ক নেই; যা আছে তা হলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং দাবিয়ে রাখা, ডমিনেট করা। ব্রাউনমিলারের মতে, ধর্ষণের কারণ যৌনকামনা নয়, সব পুরুষেরই কামনা আছে, কিন্তু সব পুরুষ ধর্ষণ করে না। একেকজন ধর্ষণকারী একেক কারণে এই ঘৃণ্য অপরাধ করে।

ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতা-সম্পর্ক আছে। ক্ষমতার আধিপত্য প্রয়োগ ও প্রমাণের অস্ত্র হলো ধর্ষণ। এবং সুসান যদিও বলছেন, এর সঙ্গে লালসার কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু সে ব্যাপারে ভিন্নমতও আছে।

কোনো কোনো গবেষক বলছেন, রেইপে দুটো ফ্যাক্টরই কাজ করতে পারে, ক্ষমতা-আধিপত্য এবং যৌনলালসা। ইউএন উইমেন ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধ দমনের জন্য সুপারিশ করেছে:

ইউএন উইমেন নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে সুপারিশ করে:

১. রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নেতৃত্ব। ২. নারী-পুরুষের সমতা আনে—এমন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা এবং কার্যকর করা। ৩. নারীদের সংগঠনে বিনিয়োগ করা। ৪. নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে তহবিল বরাদ্দ করা। ৫. প্রতিদিন নারীরা যেসব বিচিত্র বৈষম্যের মুখোমুখি হন, তা সমাধানে সচেষ্ট হওয়া।

এগুলো রাষ্ট্রের করণীয়। পরিবারেও করণীয় আছে। সমাজে করণীয় আছে। আমার বাড়িতে আমি নারীকে সম্মান করছি কি না। আমার বাবা আমার মাকে সম্মান করছেন কি না। আমার মা আমার ভাই ও বোনের মধ্যে ভাইকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কি না! স্কুলে আমরা কী শেখাচ্ছি!

কিন্তু বারবার করে ছাত্রলীগের নাম এই সব অপকর্মে কেন আসে? চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রবাজি, দখল, টেন্ডারে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নাম সব আমলেই কেন আসে?

আরও পড়ুন

এই জন্য খোলনলচে পাল্টে ফেলার দাবি তুলতে হবে। তা হলো, ক্ষমতা থেকে দলকে বিচ্ছিন্ন করা। ক্ষমতা তো রাজনৈতিক দলই চালাবে, কিন্তু ক্ষমতাযন্ত্র থেকে সংগঠনকে আলাদা করে ফেলতে হবে। একজন অপরাধ করলে সে কোন দলের তা পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ কখনো আমলেই নেবে না। আমরা এই রকম দেখে থাকি যে, শিক্ষায়তনে অপরাধের সঙ্গে সরকারি ছাত্রসংগঠন যুক্ত থাকলে প্রশাসন তাদের ঘাঁটায় না। ঘাঁটাতে ভয় পায়। ঘাঁটালে বিপদ হয়।

উল্টোটাও আছে। ভিসি বা অধ্যক্ষ বা প্রকল্প পরিচালক ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করেন নিজের ক্ষমতা বা পদ সংহত করতে। নিজেও প্রতিষ্ঠানের নানা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেন এবং এই কুচক্রে ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করেন। একেবারে গোড়া থেকে যদি এই প্রথাটাকে বিলুপ্ত করা যায়, তাহলে অনেক বড় পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সব পেশায়, সব প্রতিষ্ঠানে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, কবি, শিল্পী, সাংবাদিক—সরকারি ঝান্ডা উঁচিয়ে চলাদের দাপট। এটাই সবকিছু ভেঙে পড়ার একটা কারণ। সেই যে ইয়েটস কবিতায় বলেছিলেন: সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেন্দ্র আর কিছুই ধরে রাখতে পারছে না...

ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কালক্ষেপণ করা যাবে না। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আরও পড়ুন

এবং একটা সভ্য দেশ, আইনের শাসনের দেশ কায়েম করতে হবে। যেখানে দলীয়করণ থাকবে না। শাস্তি এবং পুরস্কারে দলীয় আনুগত্য বিচার করা হবে না। প্রশাসন—সরকারি কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠান—দলীয় রাজনীতিকরণের বাইরে থাকবে।

বিভেদ সবখানে আছে। আমেরিকাও দুই দলে বিভক্ত এক দেশ। কিন্তু তা দিয়ে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার প্রভাবিত হয় না।

ছাত্রলীগের বহু গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এই দেশের ইতিহাসে আছে। কয়েকজন অপরাধমনস্ক কর্মী সেই ইতিহাসে কাদা ছুড়ে দিচ্ছে, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা—এ কথা বলে মুখরক্ষার উপায় নেই। একটা এমন ব্যবস্থা কায়েম হয়ে আছে, যেখানে অপরাধীরা ক্ষমতার আশ্রয় নেয়, ক্ষমতা অপরাধীদের আশ্রয় নেয় এবং ক্ষমতা তার ডমিনেন্স কায়েমের জন্য ধর্ষণ করে, অপহরণ করে, অস্ত্রবাজি করে, সন্ত্রাস করে, অপরাধ করে।

আজকের ছাত্রনেতা আমাদের আমলের ছাত্রনেতাদের মতো খদ্দর পরে মধুর ক্যানটিনে শিঙাড়া খেয়ে দিন পার করে সমাজবদলের স্বপ্নে দিন কাটান না। তাঁরা ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়িতে আসেন, তাঁদের আছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।

সবকিছু ভেঙে পড়ে অবস্থা থেকে সবকিছু ঢেলে সাজানোর ডাক আসে। আর কত চুনকালি মুখে পড়লে আমরা বলব, যথেষ্ট হয়েছে, এবার সবকিছু ইতিবাচকভাবে পাল্টে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নাও।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক