পাঁচ দিন আগে এশিয়া কাপে অভিষেক হয়েছে সদ্য অনূর্ধ্ব–১৯ পেরিয়ে আসা বাংলাদেশি পেসার তানজিম হাসানের। ভারতের বিপক্ষে মাঠে নেমেই অনেকটাই দাপট দেখিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭.৫ ওভার বল করে ৩২ রানের বিনিময়ে তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট, যেখানে ছিলেন ভারতের প্রতাপশালী ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা। এশিয়া কাপ থেকে বিদায়ের ঘণ্টা আগেই জেনেছিল বাংলাদেশ, তবে ভারতের বিপক্ষে ৬ রানের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল তানজিম হাসানের।
তানজিমের ক্রিকেটের খ্যাতি যখন ছড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক সেদিনই তাঁর অতীত কিছু ফেসবুক পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলে। দেখা গেল ভারত জয়ে অসামান্য ভূমিকা রাখায় প্রশংসা পাওয়ার বদলে তাঁর এক বছর আগের কিছু পোস্ট নিয়ে তর্কবিতর্ক চরমে ওঠে। কিন্তু এক বছর আগের পোস্টগুলো কেন হঠাৎ করে এত সমালোচিত হচ্ছে? কারা তা প্রচার করছে বা কেনই প্রচার হচ্ছে? এর সম্ভাব্য ফলাফলই–বা কী?
ধর্মভীরুতার আড়ালে এই ক্রিকেটারের ফেসবুক স্ট্যাটাসে যে নারীবিদ্বেষ বা দেশপ্রেমবিরোধী অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে, তা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকেই তাঁর ভাবাদর্শকে আমাদের অতীতের ‘বিপথগামী’ যুবকদের কাতারে ফেলছেন। অনেকেই আবার তানজিমের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সমর্থনও জানাচ্ছেন।
তানজিমের বয়সী যুবকদের বিপথগামী হয়ে পড়ার খবর নতুন নয়। হোলি আর্টিজানের ঘটনার ক্ষত তৈরিতে কিংবা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর শক্তি বাড়াতে যেসব যুবক ভূমিকা রেখেছিল। ফলে তানজিমের ফেসবুকের পোস্টগুলো নিয়ে দেশের সচেতন নাগরিকেরা তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। অনেকেই সম্ভাবনাময় এই তরুণের জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, তানজিমের সংস্পর্শে যদি অন্যান্য ক্রিকেটারও একই ভাবাদর্শের অনুসারী হয়ে ওঠেন, তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরে উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে ফাটল ধরতে পারে কিংবা নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে দেশের নারী খেলোয়াড়দের নিয়ে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট বোর্ড।
২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তানজিম তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে লেখেন, ‘স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।’
অনেকেই মনে করছেন, তানজিমের এ ধরনের বক্তব্য তাঁর নিজস্ব চিন্তাচেতনার প্রকাশ। প্রশ্ন হলো, তানজিম হাসানেরা কেন নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন? তানজিমদের মস্তিষ্কে নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে কারা ভূমিকা রাখছেন?
একটু খোঁজ নিলে ফেসবুকে চোখে পড়বে তাঁদের কোমল মস্তিষ্কে বিষবাষ্প তৈরি করছে কারা। কেন তাঁরা নারী নেতৃত্বকে ভয় পায়, কেন তাঁরা তাঁদের মা-বোনদের রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করতে চান না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কোথাও যেতে হবে না। তানজিমদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফুটে উঠছে কারা তাঁদের দীক্ষাগুরু।
নিজেকে সালাফি আহলে হাদিসের অনুসারী স্বীকার করে তানজিম ওই বছর ২৪ নভেম্বর বিতর্কিত ইসলামি বক্তা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ একটি পোস্ট শেয়ার করে লেখেন ‘উস্তাদজী’। নারী নেতৃত্ব হারাম ও নারীবিদ্বেষী উগ্রবাদী বক্তব্য দেওয়ার কারণে তিনি অনেকের কাছে সমালোচিত।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে একসময় আমাদের মা-বোনদের ঘরবন্দী করে রাখা হতো। বছরের পর বছর নারীরা পুরুষদের দাসত্ব করলেও তাঁদের মুক্তি মেলেনি, কিছু বিতর্কিত ধর্মীয় বক্তার কারণে। সেই শিকল ভেঙে নারী-পুরুষদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই এ দেশে শুরু দীর্ঘদিন আগে। কিন্তু তানজিমদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে ফায়দা লোটার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছেন একশ্রেণির ধর্মীয় বক্তা। এখানে তানজিম হাসান একা নন। তাঁদের দলটি অনেক বড়। তাঁদের মতো নারীবিদ্বেষী মানুষ এই সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রিকশাচালক পর্যন্ত তানজিমদের বিস্তার। এই সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়ছে।
তানজিমদের খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে যাঁরা মত দিচ্ছেন, তাঁদের সেই চিন্তাশীলতায় কখনোই আমাদের দেশের জন্য সুখকর নয়। এর মধ্য দিয়ে তানজিমদের আরও বেশি বিপথগামী করা হতে পারে। বরং তানজিমদের মতো যাঁরা খেলাকে ভালোবাসে, যাঁরা উদীয়মান প্রতিভাবান, তাঁদের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তানজিম হাসানদের ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভলিবলে প্রয়োজন।
তানজিমদের খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে যাঁরা মত দিচ্ছেন, তাঁদের সেই চিন্তাশীলতায় কখনোই আমাদের দেশের জন্য সুখকর নয়। এর মধ্য দিয়ে তানজিমদের আরও বেশি বিপথগামী করা হতে পারে। বরং তানজিমদের মতো যাঁরা খেলাকে ভালোবাসে, যাঁরা উদীয়মান প্রতিভাবান, তাঁদের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়নের জন্য তানজিম হাসানদের ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ভলিবলে প্রয়োজন।
ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে তানজিমরা বিশ্বকে দেখবে, বিমানে নারী কেবিন ক্রুরা এসে চা-কফি দেবেন, নারী বাসচালক এয়ারপোর্ট থেকে ড্রাইভ করে তানজিমদের হোটেলে পৌঁছে দেবেন, নারী রিসেপসনিস্ট হোটেল স্টাফ তাঁদের হাতে চাবি দিয়ে হোটেল কক্ষে পৌঁছে দেবেন, ক্রিকেটের মাঠে নারী ধারাভাষ্যকার এসে জিজ্ঞাসা করবেন, ডু ইউ এনজয় দিস ইনিংস? কিংবা জানতে চাইবেন তোমাদের দেশের মেয়েরা ক্রিকেটে এগিয়ে যাচ্ছে, তোমরাও যাচ্ছ, বিশ্বকাপ কবে ঘরে তুলবে?
আর এভাবেই তানজিম হাসানেরা নারী সহকর্মী সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে একই মঞ্চে ‘ক্রিকেটের গল্প শোনাবে’।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯ হাজার ২৬৮টি মাদ্রাসায় ২৭ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, যা সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশ। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী থেকে ঠিক কতজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে পেয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান আছে কি? কেন তাঁরা আমাদের ক্রীড়ামোদী হয়ে ওঠেন না?
খোঁজ নিলে দেখা যাবে সিংহভাগ মাদ্রাসায় এসব খেলাধুলা করানোয় হয় না কিংবা সুযোগ নেই। অথচ এসব শিক্ষার্থী বাংলাদেশের ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে বেশ আগ্রহী। পত্রপত্রিকা বা অনলাইনে খেলাধুলার খবর তারা পড়ার চেষ্টা করে। সুযোগ পেলে টেলিভিশন কিংবা মাঠে গিয়ে খেলা দেখে।
বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী থেকে ক্রিকেটার, ফুটবলার কিংবা অন্য কোনো অ্যাথলেট তৈরি করতে আমাদের সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানই আগ্রহ দেখায়নি। বিকেএসপি আদৌ কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ তাদের জন্য রেখেছে কি না, তা আমার জানা নেই, তবে এই শিক্ষার্থীদের আরও বাস্তবমুখী করতে খেলাধুলার যে বিকল্প নেই, তা ভাবতে হবে। তাদের সুযোগ দিতে, তাদের মাঠে আনতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ নিতে হবে। যাতে তাঁরা বদ্ধমূল হয়, খেলাধুলা শরীর ও মন সতেজ করার রসদ।
তানজিম হাসান ক্রিকেট থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, বরং তাঁদের মস্তিষ্ককে যারা বিগড়ে দিচ্ছেন, তাঁদের রুখতে হবে। এমন তারুণ্যে ভরপুর ছেলেদের মগজ দখল করার পাঁয়তারা করে যাঁরা দেশটাকে পিছিয়ে দেওয়ায় লিপ্ত তাঁদের চিহ্নিত করুন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব যেমন ভালো-দক্ষ ক্রিকেটার খুঁজে বের করা, তেমনই ক্রিকেটকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িকতা না ছড়ায়, সেই দিকে নজর দেওয়া জরুরি। সেটি করতে না পারলে, ক্রিকেটের সাম্প্রতিক অর্জন ম্লান হয়ে পড়বে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, বিতর্কিত পোস্ট নিয়ে বিসিবির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তানজিম। এর জন্য তাঁকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, তানজিম হাসানেরা এই দেশের সম্পদ। এই রকম হাজারো সম্পদ অচিরেই ঝরে পড়ছে, কেবল ওই সব অপরিণামদর্শী মানুষদের বিষক্রিয়াময় বক্তব্যের কারণে, ভুলভাল ব্যাখ্যার কারণে। তাঁদের থামান, সাম্প্রদায়িকতা কখনোই আশীর্বাদ নয় বরং তার দংশনে বাংলাদেশ যেন নীলাভ না হয়, তা দেখভালের দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি আমাদেরও।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]