হেলাল হাফিজের ‘আশ্রয়হীনতা’ ও নিঃসঙ্গ প্রবীণেরা

শৈলান প্রবীণ নিবাস

চট্টগ্রাম থেকে ফাহমিনা মামি মেসেঞ্জারে জানতে চান, শৈলান প্রবীণ নিবাসে কবি হেলাল হাফিজের ঠাঁই হবে কি? কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ইত্যাদি। জবাব দেওয়ার আগে আমি তাঁর কাছে কবির বর্তমান অবস্থা জানতে চাই। তিনি আমাকে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ পাঠান। সেখান থেকে জানতে পারি, তিনি ঢাকার সেগুনবাগিচায় একজন কবির বাসায় আছেন। কিন্তু অসুস্থ কবিকে দেখে রাখা, নিয়ম করে ওষুধ দেওয়া তাঁর একার পক্ষে সম্ভব নয়।

অবশ্য এর কয়েক দিন পর অপর এক খবর পড়ে জানতে পেরেছি, ওই বাসায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় থাকার পর ১৪ নভেম্বর তাঁর পুরোনো আশ্রয়স্থল শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেলে ফিরে গেছেন হেলাল হাফিজ।

জন্ম-জন্মান্তরের কবি হেলাল হাফিজ ‘যুগল জীবনী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি ছেড়ে যেতে চাই/ কবিতা ছাড়ে না/ দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো/ কবিতা আমার কোলে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে/’। যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থের ‘নাম ভূমিকায়’ অগ্রসর পাঠকের এই কবি লিখেছেন, ‘গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ/ জলের কলস, কাক পলিমাটি চেনা মানে আমাকেই চেনা/ আমাকে চেনো না?/ আমি তোমাদের ডাকনাম।’

কবির বর্তমান অবস্থা

হেলাল হাফিজ ডায়াবেটিস, কিডনি আর গ্লুকোমার পাশাপাশি বার্ধক্যের নানা জটিলতায় ভুগছেন। গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। নিঃসঙ্গ হেলাল হাফিজের জীবন এক দশক ধরেই কাটছিল হোটেলে হোটেলে। এবার হাসপাতালে ভর্তির আগে ছিলেন সুপার হোম হোস্টেলে। গত ২০ অক্টোবর যখন তিনি হাসপাতাল ছাড়েন, তখন হোস্টেলের সিট খালি ছিল না।

বর্তমানে হেলাল হাফিজের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ব্লাড প্রেশার কখনো কমে, বাড়ে। মাথা ঘোরায়। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে ওঠেন। সব থেকে বড় কথা, মানসিকভাবে তিনি দিশাহারা। কারণ, তিনি নিজে চলতে পারেন না। হাসপাতালে থাকার সময় কয়েকবার ‘আত্মহত্যা’র কথাও নাকি তাঁর মনে উঁকি দিয়েছে। হাসপাতালে থাকলে খুবই একা অনুভব করেন। এ জন্য তিনি হাসপাতালে থাকতে চান না।

সম্প্রতি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কবির জন্মদিনের আয়োজন করেছিল, সেখানে অসুস্থ শরীর নিয়েই হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আয়োজকেরা হেলাল হাফিজকে ওই তরুণ কবির সেগুনবাগিচার বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। হেলাল হাফিজের আশ্রয়দাতা ওই কবি জানিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কবির সামগ্রিক দেখাশোনা করা সম্ভব ছিল না, এ জন্য একজন লোক চেয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাছে। যাঁরা কবিকে বাসায় রেখে গিয়েছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন কবির জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী জায়গার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু পরে তাঁদের পক্ষ থেকে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি এত দিনে কবির দেখভালের জন্য একজন লোকও দেওয়া হয়নি।

আমাদের অপারগতা

আমি ফাহমিনা মামিকে বলি, শৈলান প্রবীণ নিবাসে আমরা সচল, অন্যের সাহায্য ছাড়াই জীবন যাপন করতে পারেন, এমন প্রবীণদের বিনা মূল্যে আশ্রয়, পোশাক, তেল, সাবান, খাবার দিয়ে থাকি। এ ছাড়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহায়তায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও আবশ্যকীয় ওষুধ দিয়ে থাকি।

প্রবীণেরা নিজেদের বিছানা করবেন, কাপড় ধৌত করবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশা। সেখানে একজন সার্বক্ষণিক সুপারিনটেনডেন্ট, রাঁধুনি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তাপ্রহরী আছেন। একজন প্রবীণ প্যারামেডিকের দায়িত্ব পালন করছেন। একটি পরিপূর্ণ ও সুসজ্জিত চিকিৎসার কক্ষ ও ফার্মেসি থাকলেও আমাদের নিজস্ব কোনো আয়া, নার্স বা চিকিৎসক নেই।

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’-এর কবির থাকার ঠাঁই নেই জেনে আমরা ব্যথিত হয়েছি। তাঁকে সেবা প্রদানে আমাদের কাঠামোগত অক্ষমতার জন্য লজ্জা বোধ করছি। আমরা আশা করব, সরকার ও দানশীল ব্যক্তিরা তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসবেন এবং আমরা একটি জাতীয় লজ্জা থেকে মুক্তি পাব।

প্রবীণ নিবাসের প্রকারভেদ

প্রবীণ বয়সে যাঁদের পরিবারে দেখাশোনার কেউ নেই, তাঁদের জন্য কয়েক ধরনের আশ্রয় প্রয়োজন।

ক. সচল জীবনযাপন (অ্যাকটিভ লিভিং): বয়সে প্রবীণ, বার্ধক্যজনিত অসুখ-বিসুখ সত্ত্বেও সচল ব্যক্তিদের জন্য এসব নিবাস। এগুলোর গঠন অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের আবাসিক হলের মতো। এক কক্ষে একাধিক ব্যক্তির বসবাস, কমন বাথরুম, ডাইনিং ও ইনডোর গেমস, বিনোদনের জন্য টিভি ইত্যাদি থাকে। এ ধরনের প্রবীণ নিবাসে বাথরুম, আহার, ওষুধ খাওয়া, বিছানা করা, কাপড় ধোয়া প্রবীণদেরই করতে হয়। শৈলান প্রবীণ নিবাস এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান।

খ. সহায়তায় জীবনযাপন (অ্যাসিস্টেড লিভিং): অসুস্থ ও চলনশক্তিহীন প্রবীণদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা প্রয়োজন। এই শ্রেণির প্রবীণদের বাথরুম, আহার, ওষুধ খাওয়া, বিছানা করা, কাপড় ধোয়া প্রভৃতি নৈমিত্তিক কাজে অন্যের সহায়তা প্রয়োজন। তাই এ ধরনের নিবাসের গঠনও ভিন্ন হয়ে থাকে। একটি সেবাকেন্দ্র ঘিরে শোবার কক্ষগুলো চারদিকে সাজানো হয়। এক কক্ষে দুজন বাসিন্দা ও কক্ষের ভেতরেই বাথরুম থাকে। এ ধরনের নিবাসে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, নার্স ও আয়া থাকেন। যাঁরা প্রবীণদের নৈমিত্তিক কাজে সহায়তা করেন। কবি হেলাল হাফিজের এ ধরনের আশ্রয় প্রয়োজন।

গ. প্রবীণদের হাসপাতাল: দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন—এমন প্রবীণদের জন্য এ ব্যবস্থা। সাধারণ হাসপাতালের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এসব হাসপাতালে বৃদ্ধ বয়সের চিকিৎসা (স্মৃতি লোপ, আর্থ্রাইটিস, আলঝেইমার, পারকিনসন্স, হান্টিংটন প্রভৃতি) ও সেবার (জেরিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কেয়ার) বিশেষ ব্যবস্থা থাকে।

ঘ. মুমূর্ষু ব্যক্তিদের আশ্রয় (হসপিস): চিকিৎসার অতীত, মুমূর্ষু রোগীদের জন্য এ ধরনের আশ্রয় প্রয়োজন। হসপিস কেয়ার হলো একধরনের স্বাস্থ্যসেবা, যা একটি গুরুতর অসুস্থ রোগীর ব্যথা ও লক্ষণগুলোর উপশমের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং জীবনের শেষে তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো পূরণ করে। হসপিস কেয়ার ব্যথা ও যন্ত্রণা হ্রাস করে স্বাচ্ছন্দ্য এবং জীবনযাত্রার মানকে অগ্রাধিকার দেয়। হসপিস কেয়ার জীবন-দীর্ঘায়িত করার বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোর বিকল্প এমন থেরাপির ব্যবস্থা করে, যা কষ্টদায়ক নয়।

আরও পড়ুন

সাধারণভাবে করণীয়

জনসংখ্যার বয়োবৃদ্ধি, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া এবং তরুণদের ভিন্ন শহরে ও দেশের বাইরে আবাস গ্রহণের ফলে উল্লিখিত চার ধরনের আশ্রয়ের প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়বে।

বর্তমান সরবরাহ একান্তই অপ্রতুল ও সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ। সহায়তায় জীবন যাপন (অ্যাসিস্টেড লিভিং) করার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নেই বললেই চলে। বাণিজ্যিক ও দাতব্য ভিত্তিতে এ ধরনের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। ঢাকার উপকণ্ঠে জমি ও অর্থ দানে কেউ আগ্রহী হলে আমরা তাঁদের সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত।

দেশের সব বড় হাসপাতালে বৃদ্ধ বয়সের চিকিৎসা (স্মৃতি লোপ, আর্থ্রাইটিস, আলঝেইমার, পারকিনসন্স, হান্টিংটন প্রভৃতি) ও সেবার (জেরিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড কেয়ার) জন্য আলাদা বিভাগ খোলা প্রয়োজন।

হেলাল হাফিজের জন্য করণীয়

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’-এর কবির থাকার ঠাঁই নেই জেনে আমরা ব্যথিত হয়েছি। তাঁকে সেবা প্রদানে আমাদের কাঠামোগত অক্ষমতার জন্য লজ্জা বোধ করছি। আমরা আশা করব, সরকার ও দানশীল ব্যক্তিরা তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসবেন এবং আমরা একটি জাতীয় লজ্জা থেকে মুক্তি পাব।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও ট্রাস্টি শৈলান প্রবীণ নিবাস

[email protected]